গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া এ মুহূর্তের জরুরি সংস্কার

ভোট প্রদানের প্রতীকী ছবি।
আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন মনে করতেন "গনতন্ত্র তখনই শক্তিশালী হয়, যখন জনগন তাদের কন্ঠস্বরকে ব্যালটের মাধ্যমে প্রকাশ করে"।
বিখ্যাত দার্শনিক জন রলস তাঁর থিওরি অব জাস্টিস গ্রন্থে বলেছেন আধুনিক উদার গণতন্ত্র কেবল শক্তিশালী নাগরিক সমাজের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত ও ভিত্তি লাভ করে। বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক উত্তরণ এখনও অসম্পূর্ণ। আমাদের পদচারণা এখনও গণতন্ত্রের ক্রান্তিকালের আবর্তে ঘূর্ণায়মান এবং এটিকে সুসংহত করার সার্বিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ থেকেও আমরা আজকের বাস্তবতায় বহুদূরে অবস্থান করছি।
তথাপি, একটি তুলনামূলক নবীন গণতন্ত্র হিসেবে এদেশের গণতান্ত্রিক অবকাঠামোগুলো বিকাশমান পর্যায়ে রয়েছে এবং স্বাভাবিক বিবর্তন প্রক্রিয়ায়ই হোঁচট খেয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। নাগরিক সমাজও তেমনিভাবে এখনও পূর্ণাঙ্গ রূপে বিকশিত হতে পারেনি।কিন্তু নাগরিক সমাজের প্রকৃত স্বরূপটি কি? এটি কি রাষ্ট্রের অভিজাত ও উচ্চতর শ্রেণির ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সংগঠিত রূপ? না-কি তৃণমূল পর্যায়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও কাঠামোর আওতা বর্হিভূত বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি? এ প্রশ্নগুলোকে সামনে রেখেই বাংলাদেশে বিকাশমান নাগরিক সমাজ এখনও তার আত্মপরিচয়ের সন্ধান করে যাচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে যে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ প্রায়শই অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা ও অভিজাত শ্রেণির আধিক্যে নিজের গণমূখী চরিত্র ও পরিচয় গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। তৃণমূল জনগোষ্ঠীর সাথে নাগরিক সমাজের বোঝাপড়ার এই টানাপোড়েন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশে প্রধান অন্তরায় বলে বিবেচ্য। গনতন্ত্রের মর্মবাণী তৃণমূলে পৌঁছাতে হলে তাদেরকে শাসন ক্ষমতায় অংশগ্রহণের গুরুত্ব উপলব্ধি করাতে হবে। এবং তৃণমূল জনগোষ্ঠীকে শাসন ক্ষমতায় অন্তর্ভুক্তির প্রথম ও একমাত্র পথ হল সর্বজনস্বীকৃত একটি নির্বাচন।
গনতন্ত্রে নীরবতাকেও একধরণের প্রতিবাদ বলে বিবেচনা করা হয়। যেমনটা ঘটেছে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ এর নির্বাচনে। এসব নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতিই বলে দেয় জনগন হাসিনার অপশাসনের অংশ হতে কতটা অপরাগ ছিল।এই যে ভোটারবিহীন সাজানো নির্বাচন, এর ফলে প্রকারন্তরে দেশের শাসনব্যবস্থা তথা গনতন্ত্রের সাথে দেশের মানুষের এক ধরণের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। অনেকটা কাল মার্কসের সেই বিখ্যাত Alienation তত্ত্বের ন্যায় জনগণ ক্রমশ শাসন ক্ষমতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। যার ফলে ক্রমাগতভাবে শাসকের প্রতি ক্ষোভ বাড়তে থাকে। সেই ক্ষোভের বহি:প্রকাশ হল ০৫ আগস্টে জনবিক্ষোভের তোড়ে হাসিনার পলায়ন।
০৫ আগস্ট কোন একক ঘটনা নয় বরং ১৫-১৬ বছরের বঞ্চনার বিরুদ্ধে জনগণের এক দাবিতে একত্রিত হওয়া, যে দাবি ছিল স্বৈরাচারের পতনের মাধ্যমে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি। এ দাবি বিএনপি করে আসছিল প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। ০৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে কেউ কেউ সংস্কার বনাম নির্বাচনের মত একটি আপাত কুতর্ক ও প্রচারণা চালিয়ে দেশকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন৷ সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়' বনাম 'নির্বাচনে দেরি হলে সংস্কার নয়'—এই বিতর্কে রাজনৈতিক মহল এতটাই জড়িয়ে পড়েছে যে, জরুরি বিষয়গুলো থেকে তাদের নজর সরে যাচ্ছে।
কিন্তু, বাস্তবতা হলো, আমাদের দুটোই প্রয়োজন। যারা সংস্কারকে নির্বাচনের ওপরে স্থান দিচ্ছেন, তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গুরুত্ব এবং যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা যথাযথভাবে অনুধাবন করছেন না। কেননা, গত তিনটি নির্বাচনে ভোটারদের ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। দেশে একটি নির্বাচিত সরকার ও সংসদ ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি। জাতীয় নির্বাচন জনগণকে সেই অধিকার ফিরিয়ে দেবে, যেখানে তারা নির্ধারণ করতে পারে যে কে শাসনক্ষমতায় থাকবে, কে থাকবে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে নির্বাচন তথা সঠিক ভোটাধিকারের দাবি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর গণআন্দোলন সবকয়টি ঘটনার সাথে ভোটের দাবি ছিল মূল দাবি। অন্যভাবে বিষয়টিকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, শেখ হাসিনার শাসনামলে ব্যাপক দুর্নীতি ও অপশাসনের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি জনরোষ সৃষ্টি করেছিল তার কারসাজিমূলক নির্বাচনগুলো। যেহেতু এ সরকার পরিচালনায় প্রফেসর ইউনুসের মত একজন সর্বজনবিদিত ব্যাক্তি রয়েছেন, তাই জনগণ হয়তো তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে কিছুটা অপেক্ষা করতে রাজি আছে।
কিন্তু সংস্কার বনাম নির্বাচনের মত কুতর্কে জড়িয়ে সে সময়কে দীর্ঘায়িত করা সমীচিন হবে না। নির্বাচন কেবল সরকারই গঠন করে না, বরং ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করে। আমাদের শাসন ব্যবস্থায় সম্ভবত সবচেয়ে উপেক্ষিত ও অবমূল্যায়িত শব্দ হচ্ছে 'জবাবদিহিতা'। রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই একমাত্র কার্যকর উপায়। আর যে সংস্কারের দাবি তোলা হচ্ছে সেই সংস্কারের কথা সবার আগে সামনে এনেছিল বিএনপি।
তাছাড়া বিএনপির জনমুখী ম্যান্ডেট "৩১ দফার" মূলমন্ত্রই হল রাষ্ট্রের সংস্কার। তাই সংস্কারের সাথে বিএনপির বিরোধ রয়েছে এ আলাপ রীতিমত হাস্যকর৷ বর্তমানে আইনশৃংখলার যে পরিস্থিতি এবং মবোক্রেসির যে ধারা শুরু হয়েছে তার থেকে উত্তরণে এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে অতিদ্রুত জনগণের সরকারের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত করা উচিত। যে কোন অভ্যুথানের পর যে সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করে বাংলাদেশেও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি।
এই অস্থিরতা থেকে উদ্ভুত সামাজিক নৈরাজ্য নিরসনে যদি সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়া যায় তবে অভ্যুথানের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। যেমনটা ঘটেছে তিউনিশিয়ার ক্ষেত্রে। সেখানকার অভ্যুথান একটি দুর্বল গনতন্ত্রের জন্ম দিয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে অভ্যুথানের সুফল এখন ব্যাহত। রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই সংস্কার করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া, সংস্কারের উদ্দেশ্যে সুপারিশ তৈরি করা স্বল্প সময়ের মধ্যে হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত কমিশনগুলো এ লক্ষ্যে সুপারিশমালা তৈরি করতে পারে।
কিন্তু রাষ্ট্রকাঠামোতে সংস্কার আনার যে প্রক্রিয়া, তা নির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলোকেই করতে হবে। নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের ওপরে আস্থা রাখা মানে জনগণের রায়ের ওপরে আস্থা রাখা। যদি নাগরিক সমাজ ও অন্তর্বর্তী সরকার মনে করে, সুষ্ঠু নির্বাচনের পর যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের ওপরে সংস্কারের জন্য আস্থা রাখা যায় না, তবে সেই অনাস্থা জনগণের রায়ের ওপরেই অনাস্থা হবে। যে রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হবে, তারা যদি দেশ শাসনের মতো বৃহত্তর বিষয়ে জনগণের ম্যান্ডেট পায়, তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার কেন তারা করতে পারবে না?
লন্ডনভিত্তিক ব্রিটিশ-বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ মোশতাক খানের গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত ক্লায়েন্টেইলিস্ট, অর্থাৎ ক্লায়েন্ট-প্যাট্রন সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। এ ব্যবস্থার সমালোচনা করা যায় যেহেতু গনতন্ত্রের সৌন্দর্যই সমালোচনায়, কিন্তু এটাও অনস্বীকার্য যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আমলা ও অন্যান্য স্টেইকহোল্ডারদের সাথে রাজনীতিবিদদের যোগাযোগই দেশকে স্থিতিশীল করে তোলে। স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে সবাই এক প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল একটি কমন ইনিমির কথা মাথায় রেখে। হাসিনার পলায়নের পর প্রত্যেকে আবার যার যার প্লাটফর্মে ফিরে গিয়ে গোষ্ঠী স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করছে, যার ফলে তৈরি হচ্ছে নানাবিধ সংঘাত এবং মতের অমিল।
যা বৃহৎ পরিসরে দেশের সার্বিক সামাজিক পরিস্থিতি তথা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলছে। যার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে বিভিন্ন অপরাধীগোষ্ঠী। মবোক্রেসির মত অরাজগতা দীর্ঘদিন জারি থাকলে তা বহির্বিশ্বে ভুল বার্তা দিবে, ফলশ্রুতিতে উগ্রবাদী সংগঠনের উত্থানের আশংকা বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্র নিজে একটি রাজনৈতিক বিষয়, সেক্ষেত্রে রাজনীতি থেকে আলাদাকরে রাষ্ট্রকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করতে গেলে যে শূন্যতা তৈরি হবে সে শূন্যতার সুযোগ নিয়ে ঘটতে পারে পতিত ফ্যাসিবাদের পুর্নবাসন। এবারের নির্বাচন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যই একটি " এসিড টেস্ট"।
কোন রাজনৈতিক দল যদি এই "এসিড টেস্টে" অংশ নিতে অপরাগ হয় কিংবা কালক্ষেপণ করে তাহলে ধরে নিতে হবে জনগণের উপর সে দলের আস্থা নেই, যা গনতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত৷ গনতন্ত্রে তর্ক থাকবে, বিতর্ক হবে, বৈচিত্রতা থাকবে তার মধ্য দিয়েই দেশের জন্য সবচেয়ে ভালো পন্থাটিকে বেছে নিতে হবে৷ আর বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে জনসস্পৃক্ততা তৈরির একমাত্র উপায় হল সুষ্ঠু নির্বাচন। যত সংস্কারই করা হোক না কেন কোন কিছুই টেকশই হবে না যদি একটি সঠিক নির্বাচন না করা যায়। কারণ সুষ্ঠু গনতন্ত্র চর্চার একমাত্র পথই নির্বাচন৷ তাই বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হওয়া উচিত নির্বাচন সংক্রান্ত নূন্যতম সংস্কার সম্পন্ন করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়া। কারণ বর্তমান বাস্তবতায় সুষ্ঠু নির্বাচনই সবচেয়ে বড় সংস্কার।
লেখক: এফ. ফিল শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ।
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: