ঈদের নামাজের আগেই ফিতরা আদায় ওয়াজিব
ঈদে দামী নয়, সুন্দর ও পরিষ্কার পোষাক পরা উত্তম

বিশ্বে সব জাতিরই নির্দিষ্ট কিছু উৎসব রয়েছে। জাহেলি যুগেও আরবে নওরোজ ও মেহেরজান নামে দুটি উৎসব ছিল। আল্লাহপাক মুসলমানদের এর চেয়ে অধিক উত্তম দুটি উৎসব উপহার দেন। আর তা হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা।
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটো ধর্মীয় উৎসবের প্রথমটি ঈদুল ফিতর। অর্থ ‘রোজা ভাঙার দিন’। আবার একে পুরস্কারের দিবসও বলা হয়। দীর্ঘ একমাস রোজা রাখার পর মুসলমানেরা এই দিনটি ধর্মীয় কর্তব্য পালনসহ খুব আনন্দের সাথে পালন করে থাকে। আর দ্বিতীয়টি হলো ঈদুল আযহা। দুটো ঈদ আনন্দের সাথে পালন মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। নবীজি বলেন, প্রত্যেক জাতির উৎসব আছে। আমাদের উৎসব হলো দুটি ঈদ।
হাদীসে আছে- বাজারে বিক্রয় হচ্ছিল এমন একটি রেশমি জুব্বা নিয়ে উমর (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট গেলেন এবং তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি এটি কিনে নিন। ঈদ ও প্রতিনিধিদলের সাক্ষাতের সময় এটি দিয়ে নিজেকে সজ্জিত করবেন।রাসূলুল্লাহ (সা.)তাঁকে বললেন,এই দামি পোশাক যার পরকালে তার কোনো অংশ নেই। এই ঘটনার পর উমর (রা.) আল্লাহর যতদিন ইচ্ছা ছিল ততদিন অতিবাহিত করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা.) তার নিকট একটি রেশমি জুব্বা পাঠালেন। উমর তা গ্রহণ করলেন এবং সেটি নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট এসে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল আপনি তো বলেছিলেন, এ হচ্ছে তাদের পোশাক যাদের পরকালে কোনো অংশ নেই। এতদ সত্বেও এ জুব্বাটি আপনি আমার কাছে পাঠিয়েছেন! রাসূলুল্লাহ (সা.)তাকে বললেন, তুমি ওটা বিক্রি করে দাও এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করো। ইসলামে নতুন পোশাক পরিধান করার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বিভিন্ন দেশে তা বহুল প্রচলিত একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে। তাই নবীর শিক্ষা ঈদে দামী পোষাক নয়, সুন্দর ও পরিষ্কার পোষাক পরা উত্তম।
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ঈদ পালন করা হয় দ্বিতীয় হিজরি বর্ষের বদরের বিজয়ের ১৩ দিন পর পহেলা শাওয়াল। যা ছিল প্রথম ঈদুল ফিতর উদযাপন। একই বছর মদিনার সুদখোর মহাজন ইহুদি বনুকাইনুকা সম্প্রদায়কে নিরস্ত্র করার পর ১০ জিলহজ ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ পালন করা হয়।
ঈদের নামাজ পুরুষদের জন্য ওয়াজিব। ফযরের নামাজের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর ঈদুল ফিতরের নামাজের সময় হয়। এই সময় হলো সূর্যোদয়ের পর থেকে দিবসের মধ্যভাগের আগ পর্যন্ত। এই নামাজের জন্য আজান ও ইকামত দিতে হয় না। সকাল বেলায় এই নামাজ পড়া হয়। রমজানের ঈদ অপেক্ষা কোরবানি ঈদে জামাত একটু আগেই করা হয়। কারণ, তার পরে কোরবানি পশু জবাইসহ নানা কাজ থাকে।
রমজানের ঈদের নামাজের আগে এবং কোরবানি ঈদের নামাজের পরে প্রাতঃরাশ গ্রহণ করা সুন্নত। ঈদের নামাজ একাকী আদায় করা যায় না। দুই রাকাত ঈদের ওয়াজিব নামাজ ছয়টি অতিরিক্ত ওয়াজিব তাকবিরসহ আদায় করতে হয়। শুক্রবারে জুম্মার নামাজের পূর্বে ইমাম খুৎবা প্রদান করলেও ঈদের নামাজের ক্ষেত্রে তা নামাজের পরে প্রদান করাই নিয়ম। ঈদুল ফিতরের নামাজ শেষে খুৎবা প্রদান ইমামের জন্য সুন্নত; তা শ্রবণ করা নামাজির জন্য ওয়াজিব।
মুসলমানদের বিধান অনুযায়ী ঈদের নামাজ আদায় করতে যাওয়ার আগে একটি খেজুর কিংবা মিষ্টান্ন খেয়ে রওনা হওয়া সওয়াবের কাজ। ঈদুল ফিতরের ব্যাপারে ইসলামী নির্দেশসমূহের মধ্যে রয়েছে গোসল করা, মিসওয়াক করা, আতর-সুরমা লাগানো এক রাস্তা দিয়ে ঈদের মাঠে গমন এবং নামাজ শেষে ভিন্ন পথে গৃহে প্রত্যাবর্তন। এছাড়া সর্বাগ্রে অযু-গোসলের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া উত্তম।
রমজান মাসের রোজার ভুলত্রুটি দূর করার জন্যে ঈদের দিন অভাবী বা দুস্থদের কাছে ফিতরা প্রদান করা ওয়াজিব। ঈদের নামাজের পূর্বেই ফিতরা আদায় করার বিধান রয়েছে। তবে ভুলক্রমে নামাজ পড়া হয়ে গেলেও ফিতরা আদায় করার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে। ফিতরার ন্যূনতম পরিমাণ ইসলামি বিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট।
সাধারণত ফিতরা নির্দিষ্ট পরিমাণ আটা বা অন্য শস্যের যেমন, যব, কিসমিস এসবের মূল্যের ভিত্তিতে হিসাব করা হয়। সচরাচর আড়াই সের আটার স্থানীয় মূল্যের ভিত্তিতে ন্যূনতম ফিতরার পরিমাণ নিরূপণ করা হয়। ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী, যাকাত পাওয়ার যোগ্যরাই ফিতরা লাভের যোগ্য।
এ বছর বাংলাদেশে ফিতরার হার জনপ্রতি সর্বনিম্ন ১১০ টাকা ও সর্বোচ্চ দুই হাজার ৮০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। শরীরের জাকাত সদকাতুল ফিতর। এটি আদায় করলে রমজান মাসের ভুলের কাফফরা হয়ে যাবে। উত্তম, মধ্যম, নিম্ন আয় অনুযায়ী আপনাকে ফিতরা আদায় করতে হবে। আপনি ধনী হয়ে যদি সর্বনিম্ন ১১০ টাকা ফিতরা আদায় করেন তা সহীহ হবেনা। সামর্থ্য অনুযায়ী আপনাকে ফিতরা আদায় করতে হবে।
ঈদের আগের রাতটিকে ইসলামে পুরস্কার রজনী এবং আমাদের ভাষায় ‘চাঁদরাত’ বলা হয়। শাওয়াল মাসের চাঁদ অর্থাৎ সূর্যাস্তে এক ফালি নতুন চাঁদ দেখা গেলে পরদিন ঈদ হয়, এই কথা থেকেই চাঁদরাত কথাটির উদ্ভব। ঈদের চাঁদ স্বচক্ষে দেখে তবেই ঈদের ঘোষণা দেওয়া ইসলামী বিধান।
আধুনিককালে অনেক দেশে গাণিতিক হিসাবে ঈদের দিন নির্ধারিত হলেও বাংলাদেশে ঈদের দিন নির্ধারিত হয় দেশের কোথাও না কোথাও চাঁদ দর্শনের ওপর ভিত্তি করে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে। দেশের কোনো স্থানে স্থানীয় ভাবে চাঁদ দেখা গেলে যথাযথ প্রমাণ সাপেক্ষে ঈদের দিন ঠিক করা হয়। চাঁদরাত ও ইবাদতের রাত। দামি রাত।ওই রাতে আমরা অনেকে মার্কেটে সময় কাটাই। ঈদের দিনের মতো রাও দামি। বেশি সময় ইবাদতে কাটানোর চেষ্টা করা উচিত।
হাদীসে আছে, রাসূল(সা.) ঈদুল ফিতরের দু’রাকাত নামাজ পড়লেন। এর আগে বা পরে কোনো নামাজ পড়লেন না।অতঃপর তিনি বিলালকে সাথে নিয়ে মহিলাদের নিকট গেলেন এবং তাদেরকে (আল্লাহর পথে জিহাদের উদ্দেশে) দানের জন্য বললেন।তখন তারা দান করতে শুরু করলো; কেউ দিলো সোনা বা রূপার আংটি আবার কেউ বা দিল গলার হার।
ঈদের দিন প্রথমে ফজরের নামাজ আদায় করতে হবে। কারণ, এই ফরজ নামাজ কোনো মতে ছাড়া যাবেনা।তারপর সকালে ওয়াজিব ঈদের নামাজের প্রস্তুতি নিতে হবে। সর্বাগ্রে অযু-গোসলের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া দরকার। এরপর আনুষ্ঠানিকতা হলো নতুন জামা-কাপড় পরে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া। ঈদের নামাজ সবার জন্য।নামাজের পর সবাই একসাথে হওয়া,দেখা করা। ঈদের দিনে সালামি গ্রহণ করা প্রায় সবদেশেই রীতি আছে।তবে এর ধর্মীয় কোনো বাধ্যবাধকতা বা রীতি নেই। সাধারণত ঈদের নামাজের পরে মুসলমানরা সমবেতভাবে মুনাজাত করে এবং একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলি করে ঈদের সম্ভাষণ বিনিময় করে থাকে।
এক ঈদের দিন মহানবী (সা.) রাস্তার পাশে একটি ছেলেকে কাঁদতে দেখেন। তিনি তার কাছে যান। ছেলেটি বলল, তার মা ও বাবা কেউই নেই। মহানবী (সা.) ছেলেটিকে তাঁর ঘরে নিয়ে আসেন। বললেন, আমি তোমার পিতা, আর আয়েশা তোমার মা।ফাতেমা তোমার বোন আর হাসান-হোসাইন তোমার খেলার সাথী। মহানবী (সা.) ছেলেটিকে সন্তানের মর্যাদা দান করেন।এভাবে মহানবী (সা.) ঈদের দিন অসহায়দের সহায়তা দান করতেন। আল্লাহপাক আমাদের মহানবী (সা.) ও সাহাবায়েকেরামের মতো ঈদ উদযাপন করার তৌফিক দিন।
ঈদের দিনে আমাদের সেমাই সবচেয়ে প্রচলিত খাবার। এবং বিশেষ আরো অনেক ধরনের খাবার ধনী-গরিব সকলের ঘরে তৈরি করা হয়। এ উৎসবের আরো একটি রীতি হলো আশেপাশের সব বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া এবং প্রত্যেক বাড়িতেই হালকা কিছু খাওয়া। এ রীতি দেশে প্রায় সবাই মেনে থাকে। তবে ভেজালের কারণে সেমাই কম খাওয়াই উত্তম। সবশেষে বলা যায়, আমাদের ঈদের বিশেষ শুভেচ্ছাসূচক সম্ভাষণটি হলো, ‘ঈদ মুবারাক’।
বিভি/এসজি
মন্তব্য করুন: