দেশবরেণ্য শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকীতে দোয়া ও আলোচনা সভা

দেশবরেণ্য প্রয়াত শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) আফতাব নগর সাইট অফিসে এই দোয়া ও আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়।
দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন ইস্টার্ন হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ধীরাজ মালাকার, অপারেশন ডিরেক্টর ও সাইট ইনচার্জ অবসরপ্রাপ্ত মেজর আলটামাস করিম এবং এম সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আলমগীর। দোয়া পরিচালনা করেন মওলানা মোস্তাফিজুর রহমান।
কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর থানার ভাগলপুরের ঐতিহ্যবাহী বর্ধিষ্ণু গ্রামে ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট জহুরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন। দেশের সফল উদ্যোক্তা ও শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম ১৯৯৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে সিংগাপুর যান। এরপর সেখানেই ১৮ অক্টোবর রাতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
জহুরুল ইসলামের বাবা আলহাজ্ব আফতাব উদ্দিন আহম্মদ এবং মা রহিমা আক্তার খাতুন। তাঁর বাব ছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৯৫৮-১৯৬৮ পর্যন্ত বাজিতপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। এলাকার জনহিতকর কর্মকাণ্ডে তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য।
জহুরুল ইসলাম এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের ধারক ও বাহক। মুঘল আমলের মধ্যভাগে জহুরুল ইসলামের পুর্বপুরুষ তিন ভাই– বাজেত খাঁ, ভাগল খাঁ ও দেলোয়ার খাঁ মুঘলশাহের দরবারী আমলা হয়ে এই এলাকায় আসেন। যা পরবর্তীতে বাজেত খাঁর নামানুসারে বাজিতপুর, ভাগল খাঁর নামানুসারে ভাগলপুর ও দেলোয়ার খাঁর নামানুসারে বর্তমান দিলালপুর নামকরণ হয়।
জহুরুল ইসলাম ভাগল খাঁর পরিবারের ত্রয়োদশ বংশধর। শৈশবে জহুরুল ইসলামকে সবাই ‘সোনা’ বলে ডাকতো ও যৌবনে পরিচিতরা ‘জহুর ভাই’ বলে সম্বোধন করতো। ক্রীড়া অনুরাগী জহুরুল ইসলাম মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সদস্য ছিলেন এবং নাভানা ক্রিকেট টুর্নামেন্টের তিনি পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। জহুরুল ইসলাম স্থানীয় প্রাইমারী স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণি শেষ করে কিছুদিন সরারচর শিবনাথ হাইস্কুলে অধ্যয়ন করেন। এরপর বাজিতপুর হাইস্কুলে উচ্চতর শ্রেণিতে লেখাপড়া চলাকালীন চাচা মহকুমা প্রকৌশলী মুর্শিদ উদ্দিনের সাথে কলকাতায় চলে যান। সেখানে ইংরেজি মাধ্যমে কলকাতা রিপন হাই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বর্ধমান জেলার এক কলেজে আই, এ কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ও পরিস্থিতির চাপে চলে এসে কিছুদিন মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে অধ্যয়ন করেন। প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিবারিক দায়দায়িত্বের চাপে তিনি আর লেখাপড়ায় এগুতে পারেননি । সেই জন্যই শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আজীবন মুক্ত হস্ত।
১৯৪৮ সালে মাত্র ৮০ টাকা মাসিক বেতনে সিএন্ডবি এর ওয়ার্ক এসিস্টেন্ট এর চাকুরীতে নিযুক্ত হন। তিন বছর পর ১৯৫১ সালে চাকুরীতে ইস্তেফা দেন। এবার তিনি ঠিকাদারী কাজে নিজেকে যুক্ত করেন। প্রথম ঠিকাদার হিসেবে তিনি এক সরকারি অফিসে ১২শ’ টাকার স্টেশনারী সরবরাহ করেন। তিনি কিশোরগঞ্জে পোস্ট অফিস নির্মাণ এবং তার পরবর্তীতে গুলিস্থান থেকে টিকাটুলী সড়কের ঠিকাদারী পান। এরপর থেকে তাকে আর পিছু ফিরতে হয়নি। মাত্র ২ বছরের মাথায় তিনি নিজেকে একজন ১ম শ্রেণির ঠিকাদার হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
আর্থিক অবস্থা পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে তিনি পিতার ১৩ সদস্যের পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে যান এবং ১৩ সদস্যের একান্নবর্তী পরিবার এক সময় বিশাল এক পরিবারে রূপ নেয় যা তিনি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ধরে রেখেছিলেন।
১৯৫৬ সালে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার থানার স্বনামধন্য পরিবারে অধ্যাপক মোশাহেদ আলী চৌধুরীর কন্যা সুরাইয়া বেগমের সাথে তিনি বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। সুরাইয়া বেগম ছিলেন তার অনুপ্রেরণা।
একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর বিশেষ অবদান প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বিচারপতি মরহুম আবু সাঈদ চৌধুরীর লেখা, ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, জহুরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ১০ জুন ঢাকা ত্যাগ করে লন্ডন চলে যান।
সেখানে তিনি ‘সুবেদ আলী’ছদ্মনাম ধারণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মরহুম আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে মোটা অংকের নগদ আর্থিক অনুদান প্রদান করেন।
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খানের লেখা ‘স্বৈরাচারের দশ বছর’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, জহুরুল ইসলাম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সরকারের জেলে আটক নেতাকর্মীদের মোকদ্দমাদির খরচ, আহতদের চিকিৎসার খরচ এবং ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার খরচ ব্যক্তিগতভাবে বহন করেন। এভাবে তিনি বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিকের ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: