ছোট্ট হাতে সংসারের হাল; শিশুশ্রম থেকে কবে মুক্ত হবে দেশ?

সৌমিক আজাদ এশা
শৈশব মানে আনন্দ, স্বপ্ন আর সম্ভাবনার দিগন্ত। কিন্তু দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও সামাজিক অসচেতনতার চক্রে আটকা পড়া শিশুরা তাদের শৈশব হারিয়ে ফেলে। এদের অনেকেই স্কুলের চৌকাঠ পেরোতে না পেরোতেই ঝরে পড়ার খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য হয়। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, “অনেক শিশু স্কুলে ভর্তি হলেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না। কারণ পরিবারে সামর্থ্যবান কেউ থাকলে স্কুল পাঠানো সহজ হয়, আর যাদের কেউ নেই বা দরিদ্র , অল্পবয়সেই দায়িত্বের বোঝা কাঁধে নিয়ে তাদের জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়।”
পটুয়াখালীর নিউ মার্কেট রোডের থানাপাড়া এলাকার একটি ছোট গ্যারেজে কাজ করছে ৯ বছর বয়সী রাব্বি । পরনে তার ময়লা লুঙ্গি আর ছেঁড়া শার্ট। হাতে তেলের চিটচিটে দাগ আর ঘর্মাক্ত মুখে ক্লান্তির ছাপ । নিয়ম মোতাবেক ৮ ঘন্টার শ্রম হিসাব থাকলেও এই রিপেয়ারিংয়ের দোকানে তাকে ঘাম ভরাতে হয় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। রাব্বি জানায়, “সংসারে আর্থিক খরচ যোগাতে এই অল্প বয়সেই তাকে দিন রাত এক করে কাজ করতে হয় । সে স্কুলে যায় না কারণ স্কুল তার ভালো লাগেনা ।”
শুধু রাব্বি নয়, পটুয়াখালীর নতুন বাজার, বাসস্ট্যান্ড, বিভিন্ন গ্যারেজ ও চায়ের দোকানে শিশুশ্রমিকের উপস্থিতি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কেউ খাবার হোটেলে কাজ করছে, কেউ ভারি মালপত্র তুলছে, কেউ গাড়ির যন্ত্রপাতি মেরামত করছে। এদের অধিকাংশের বয়সই ৮ থেকে ১৪ বছর ।
জাতিসংঘের শিশু তহবিল (UNICEF) প্রকাশিত ২০২৩ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩৪ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে, যার অধিকাংশ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করছে। ২০২৪ সালে ইউনিসেফ এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO)যৌথভাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও দেশে শিশুশ্রমের ঝুঁকির চিত্র দেখা যায়। তথ্য বলছে, দেশে ৮ থেকে ১৭ বছর বয়সে প্রায় ৩.৫৪ মিলিয়ন শিশুশ্রমে নিযুক্ত রয়েছে, যার মধ্যে ১.০৭ মিলিয়ন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত।
শিশুশ্রম কেবল একটি শিশু বা তার পরিবারের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্যই নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। শিশুশ্রমের ফলে শিশুরা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত হয়। কঠোর পরিশ্রম তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট করে, শিক্ষার সুযোগ কেড়ে নেয় এবং তাদের জীবনের সম্ভাবনাগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO)এর শ্রম অধিকার বিশেষজ্ঞ সাইয়েদ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, "শিশু শ্রম বন্ধ করতে হলে দরিদ্র পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। পাশাপাশি সরকার ও এনজিওগুলোর মাধ্যমে শিশুদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি ও প্রণোদনা বৃদ্ধি করতে হবে। আইনের কার্যকর প্রয়োগও অপরিহার্য।"
লাল সবুজ সোসাইটির লিডার এস.এম.সোহান বলেন, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও সামাজিক বাধ্যবাধকতা। প্রতিটি শিশু নিরাপদ, সহিংসতা ও শোষণমুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠার অধিকার রাখে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অনেক শিশু এখনও বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন, অবহেলা এবং ঝুঁকির মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে।
একজন সংগঠক হিসেবে আমি মনে করি, আমাদের সবাইকে শিশু সুরক্ষায় সচেতন হতে হবে এবং একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদের সংগঠন শিশুদের জন্য নিরাপদ স্থান গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা এখন স্থানীয় কমিউনিটিকে সচেতন করছি ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর সহযোগিতায় বিভিন্ন স্কুলে সুরক্ষা মেলা- ভালো স্পর্শ খারাপ স্পর্শ সেশন , অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি,শিক্ষকদের সাথে নিয়মিত ওরিয়েন্টেশন কর্মশালা এবং শিশুদের নিজস্ব অধিকার সম্পর্কে জানাতে কাজ করছি।
চলুন, আমরা এক হয়ে এমন একটি সমাজ গড়ে তুলি, যেখানে প্রতিটি শিশু ভালোবাসা, সম্মান এবং নিরাপত্তা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। কারণ আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।"
বাংলাদেশে শিশুশ্রম বন্ধে বেশ কয়েকটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যেমন বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে শিশুদের কাজ করা নিষিদ্ধ। তবে এসব আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আইন বাস্তবায়নে দুর্বলতা, পর্যাপ্ত তদারকির অভাব এবং সামাজিক সচেতনতার ঘাটতি আইনগুলোর কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করছে।
সবমিলিয়ে শিশুশ্রমের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে সমাজের প্রতিটি অংশের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পরিবার, স্কুল, সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে একত্রে কাজ করতে হবে। কারণ শিশুরা হলো জাতির ভবিষ্যৎ, তাদের শিক্ষা ও সুস্থ্য শৈশব নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। রাব্বির মতো হাজারো শিশুর জীবন বদলানো না গেলে দেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা সংকটাপন্ন হবে। তাই মে দিবসের আলোচনায় থাকুক শিশু শ্রমও।
লেখক: শিক্ষার্থী
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: