• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

থানায় নিয়ে নির্যাতন, ১৮ লাখ টাকার স্বর্ণলুটঃ আড়াই বছরেও মেলেনি বিচার

প্রকাশিত: ১৬:৫২, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

ফন্ট সাইজ

পুলিশি নির্যাতনের ভয়াবহতার বর্ণনা দিতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন রাজীব কর। ডিএমপি'র কোতোয়ালী থানার তিন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও স্বর্ণলুটের অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগী এই ব্যক্তি। তাঁর অভিযোগ, মধ্যরাতে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে চোখ বেঁধে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। এরপর সেখানে ভোররাত পর্যন্ত চলে নির্মম নির্যাতন। 

২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে ঘটে এমন নির্মম ঘটনা। নির্যাতনের ভয়াবহতার এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তাঁকে নেওয়া হয় মিটফোর্ড হাসপাতালে। কিন্তু কেন এই ভয়াবহ নির্যাতন এবং কী অভিযোগ ছিলো তাঁর বিরুদ্ধে, তা আজও জানতে পারেননি তিনি। নির্যাতনের বিচার তো দূরের কথা, সেদিন রাতে লুট করা ১৮ লাখ টাকার স্বর্ণও ফেরত পাননি তিনি গত আড়াই বছরেও। বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও মেলেনি প্রতিকার।
 
বাংলাভিশন ডিজিটালকে রাজীব জানান, তাঁতীবাজার থেকে সোনার গয়না কিনে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে সোনার দোকানে পাইকারি বিক্রি করতেন তিনি। ১০ ফেব্রুয়ারি গ্রামে নিয়ে বিক্রির জন্য ২৮ ভরি সাড়ে ১১ আনা সোনার গয়না কেনেন তিনি। ওইদিন রাত আড়াইটার দিকে এসআই মিজান ও এএসআই ফরিদ দরজা ভেঙে তাঁর তাঁতীবাজারের বাসায় প্রবেশ করেন। বাসা তল্লাশি করে সোনা, নগদ টাকা, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে যান তারা। ধরে নিয়ে যান রাজীবকেও।

রাজীবের দাবি, ওইদিন রাতে মোটরসাইকেলে করে চোখ বেঁধে কোতোয়ালী থানায় নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। সেখানে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে তাঁকে পেটান এসআই মিজান। এসময় মিজান-এর সংগে যোগ দেন এসআই আব্দুল জলিল ও এএসআই ফরিদ ভূঁইয়া। থানায় নির্মম নির্যাতনের শিকার রাজীব এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে আবারও থানায় এনে নির্যাতন করা হয়। এসময় তাঁর কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন এসআই জলিল, এসআই মিজান এবং এএসআই ফরিদ। দেওয়া হয় প্রাণে মারার হুমকিও।

রাজীব বলেন, দ্বিতীয় দফা নির্যাতনের কারণে আমি এক প্রকার নিথর হয়ে পড়ি। এসময় পানি চাইলে তারা আমাকে বলে প্রস্রাব করে পানির মতো খেতে। তারা আমাকে পিটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। আমার শরীরের বিশেষ অংশে ইলেকট্রিক শকও দেয় তারা। আমি চিৎকার করার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলি। কোনো মতে সব শক্তি দিয়ে শুধু বলতে থাকি, আমি কোনো দোষ করলে আমাকে কোর্টে পাঠান। প্লিজ মারবেন না। তারা বলে, '৫ লাখ টাকা দিলে তোকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তা না হলে কোর্টে নয়, একদম ওপারে পাঠিয়ে দেবো।'
 
ভুক্তভোগী রাজীব বলেন, তখন আমি বললাম আমার সবই তো আপনারা নিয়ে নিয়েছেন। আমার কাছে আর টাকা নাই। তখন তারা বলে, বাড়ি থেকে ফোন করে টাকা আন। তারপর আমার ফোনটা তারা ফেরত দেয়। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে যখন লক খুলি তখন ফোনের স্ক্রিনে আমার বউয়ের ছবি দেখতে পায় তারা। এসময় এসআই মিজান বলে, তোর বউ তো দেখতে জোস। ওকে আমাদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা কর! একথা বলে ডুকরে কেঁদে ওঠেন রাজীব।

নির্যাতন থেকে বাঁচাতে বড় ভাই আশীষ কর ওই পুলিশ সদস্যদের দুই লাখ টাকা দিয়ে রাজীবকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেন, জানান রাজীব। এরপর গ্রামে নিয়ে প্রায় তিন মাস চিকিৎসা দেওয়া হয় তাঁকে। কিছুটা সুস্থ হয়ে রাজীব পুলিশ সদর দফতরে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতরে অভিযোগ করেন। কিন্তু দীর্ঘ আড়াই বছরেও মেলেনি বিচার। অন্যদিকে, টাকার অভাবে আদালতে মামলাও করতে পারছেন না বলে জানান রাজীব। শেষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে অভিযোগ জমা দেন তিনি। মানবাধিকার কমিশন থেকে মামলা করতে সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু আইনজীবীর ফি সংগ্রহ করতে না পেরে এখনও মামলায় এগুতে পারেননি রাজীব।

তিনি বলেন, আমি জানি পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করলেও কিছু হবে না। আমি এও জানি, আমার উপর যে নির্যাতন হয়েছে তার বিচারও পাবো না। আমি শুধু আমার কাছ থেকে লুট করা স্বর্ণগুলো ফেরত চাই। টাকা ছাড়া আমি বাঁচার কোনো পথ দেখছি না। এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে, সপরিবারে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় নাই।

তিনি বলেন, এখন আমাদের সংসার চলছে একটা দুধের গাভী দিয়ে। দুধ বিক্রি করে যা টাকা পাই, তা দিয়েই কোনোমতে জীবন পার করছি। এমনকি বাচ্চার জন্য মাটির ব্যাংকে কিছু খুচরা টাকা জমিয়েছিলাম, তাও খরচ হয়ে গেছে।

রাজীব কর-এর অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) এবং পুলিশ সদর দফতরে যোগাযোগ করা হলেও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে অভিযুক্ত এসআই মিজানকে ফোন করা হলে তিনি এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজী হননি। অন্য দুই পুলিশ সদস্য এসআই জলিল ও এএসআই ফরিদ ভূঁইয়া'র ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার কল করলেও তাঁরা সাড়া দেননি।

এসআই মিজান-এর কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা দু'বছর আগের ঘটনা। অনেক আগেই মিটমাট হয়ে গেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিভাগীয় মামলা হয়েছিলো। তবে এটা তো তখনই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। রাজীব করকে থানায় আনেননি বলেও দাবি করেন এসআই মিজান।

রাজীব কর-এর সংগে ঘটে যাওয়া নির্মম নির্যাতনের ঘটনা ফৌজদারী অপরাধ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তাঁর মতে, এই ধরনের ঘটনায় কর্মচারি বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় মামলার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলা হওয়া উচিত। 
 
তিনি বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, কোনো সাধারণ ব্যক্তি যদি অন্য সাধারণ ব্যক্তিকে আঘাত বা নির্যাতন করে সেটি যেমন ফৌজদারি অপরাধ, তেমনি পুলিশ যদি সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করে সেটিও ফৌজধারি অপরাধ। এটি কোনোভাবেই পুলিশের বিভাগীয় মামলায় সমাধানযোগ্য নয়। সাধারণ ব্যক্তিরা হয়তো আইন না জেনে অপরাধ করে, কিন্তু পুলিশ তো আইন জেনেই নির্যাতন করছে, এটা আরও মারাত্মক অপরাধ। 

এই ধরনের ঘটনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার সংকট এবং ক্ষমতার অপব্যবহারই মূল কারণ বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান। তাঁর মতে, এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। 

ড. জিয়া রহমান বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, পুলিশের অবারিত ক্ষমতা এবং জবাবদিহিতার সংকট থাকায় এ ধরনের অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। তাই এমন ঘটনা মোকাবিলায় পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের আরও বেশি আন্তরিক হতে হবে। দুয়েকজন সদস্যের অপকর্মের জন্য পুলিশের বিরাট বিরাট সাফল্য ম্লান হতে দেওয়া যাবে না। 

একই কথা বললেন সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৈাহিদুল হক। তাঁর মতে, পুলিশের এ ধরনের ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার ঘাটতি তৈরি করে। 

তিনি বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, পুলিশের কাজই হলো নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যখন সেই পুলিশ অনিরাপদ হয়ে ওঠে, তখন এই বাহিনীর প্রতি সমাজের সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়। তাই এই সংকট নিরসনে পুলিশ প্রধানদের উচিত অপরাধে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। পুলিশ সদস্যদের অপরাধের শাস্তিস্বরূপ শুধু বদলি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে, তা নিরসন করা সম্ভব হবে না।

বিভি/এসএইচ/এসডি

মন্তব্য করুন: