• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

সিটিটিসি’র প্রতিবেদন

‘রাজারবাগ পীর ও অনুসারীদের কার্যক্রম জঙ্গিদের সংগে সাদৃশ্যপূর্ণ’

প্রকাশিত: ২১:০১, ৫ ডিসেম্বর ২০২১

ফন্ট সাইজ
‘রাজারবাগ পীর ও অনুসারীদের কার্যক্রম জঙ্গিদের সংগে সাদৃশ্যপূর্ণ’

রাজারবাগের পীর দিল্লুর রহমানসহ তার সহযোগীরা কুরআন ও হাদিসের খণ্ডিত ব্যাখ্যা দিয়ে দেশের ধর্মভীরু মানুষকে ভুলপথে পরিচালনা করছে। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা ও তথাকথিত জিহাদকে উস্কে দিচ্ছে। তাদের কার্যক্রম জঙ্গিদের কার্যক্রমের সংগে সাদৃশ্যপূর্ণ। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

পূর্ব নির্দেশনা অনুসারে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার পর রাজারবাগ পীরের অনুসারীদের বিরুদ্ধে এমন প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করেছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। মামলার নির্ধারিত দিন হিসেবে রবিবার (৫ ডিসেম্বর) বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়।

মামলার তদন্তের স্বার্থে সিআইডি, কাউন্টার টেরোরিজম ও দুদক চাইলে রাজারবাগ দরবার শরীফের পীরের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে বলে রবিবার আদেশ দেন হাইকোর্ট। একইসংগে রাজারবাগ দরবার শরীফ ও পীরের কর্মকাণ্ডের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি করতে কাউন্টার টেরোরিজমকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। 

রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির ও অ্যাডভোকেট এমাদুল হক বশির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজারবাগ পীর ও তার অনুসারীরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জন্মস্থান গোপালগঞ্জের নাম বদলে গোলাপগঞ্জ করে তাদের আলোচ্য পত্রিকার (দৈনিক আল ইহসান ও মাসিক আল বাইয়্যিনাত) মাধ্যমে প্রচার করছে। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন করে নূরানীগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও জেলার নাম পরিবর্তন করে নূরগাঁও, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাম পরিবর্তন করে আমানবাড়িয়া- এরকম আরও বেশ কয়েকটি জেলা ও স্থানের নাম পরিবর্তন করে তারা নিজেদের সাম্প্রদায়িক মনোভাব দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, পর্যালোচনায় দেখা যায়, মানুষের ধর্মানুভূতি কাজে লাগিয়ে এই পীর এবং তার দরবার শরিফ সামাজিকভাবে কুসংস্কার, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। পীর দিল্লুর রহমান-এর দরবার থেকে প্রকাশিত আলোচিত দুটি পত্রিকার মাধ্যমে গুটি কয়েক ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে নানাভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটছে। তাদের এসব কার্যক্রম সরাসরি সরকারি নীতিমালা, দেশের প্রচলিত আইন, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সংগে সাংঘর্ষিক এবং সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরোধী। দেশের বিভিন্ন থানায় রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর ও তার মুরিদদের বিরুদ্ধে রুজুকৃত মামলা ও মামলাগুলো তদন্তের ফলাফলে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

সিটিটিসি’র প্রতিবেদনের মতামত অংশে বলা হয়েছে, রাজারবাগ দরবারের নিয়ন্ত্রণাধীন পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা, তাদের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত বিভিন্ন বই, ইতোপূর্বে তাদের কার্যক্রম এবং বিভিন্ন জেলায় তাদের অনুসারীদের কার্যক্রমের কারণে রুজুকৃত মামলা ও মামলাগুলোর তদন্তের ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- তারা ইসলাম ধর্মের নামে এবং অনেক ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের খণ্ডিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে  দেশের ধর্মভীরু মানুষকে ভুলপথে পরিচালিত করে। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা ও তথাকথিত জিহাদকে উসকে দিচ্ছে। 

আরও বলা হয়, এ দেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলো যে উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের মতবাদ প্রচার করছে ও কার্যক্রম চালাচ্ছে, রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর, তার সহযোগী ও অনুসারীদের কার্যক্রম জঙ্গিদের কার্যক্রমের সংগে সাদৃশ্যপূর্ণ। বিভিন্ন মতাবলম্বী ও ভিন্ন ধর্মের মানুষকে, তাদের ভাষায় মাল’উনদের হত্যা করা ইমানি দায়িত্ব উল্লেখ করে ফতোয়া এবং এক্ষেত্রে কতল করার আদেশ দিয়েছে—যা মূলত বাংলাদেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের মানুষকে হত্যা করার ফতোয়ার অনুরূপ। এটি ইসলামের নামে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর মতো একই প্রক্রিয়ায় বিরোধীদের অর্থাৎ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করার ও ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করার কৌশল। তাদের এ ধরনের বক্তব্য মানুষকে জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত করবে, অসহিষ্ণু করবে, অসম্প্রদায়িক চেতনা নষ্ট করতে ভূমিকা রাখবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সার্বিক পর্যালোচনায় সুস্পষ্টভাবে সিটিটিসি’র কাছে প্রতীয়মান হয় যে তারা এখনও জঙ্গি সংগঠন হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত না হলেও তাদের বিভিন্ন প্রকাশনা, বক্তব্য, মুরিদ ও অনুসারীদের প্রতি তাদের নির্দেশনার ফলে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। একইসংগে তাদের এসব বক্তব্য ও প্রচার প্রচারণার কারণে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া ব্যক্তিদের ‘লোন উলফ' হামলায় উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

ওই প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ থাকায় রাজারবাগ দরবার শরিফ নজরদারিতে রাখতে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যা্ন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমকে (সিটিটিসি) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে হাইকোর্ট তার আদেশে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ-সিআইডি ও কাউন্টার টেরোরিজমের ইউনিটের প্রতিবেদনে জঙ্গি সম্পৃক্ততাসহ বেশ কিছু অভিযোগ ওঠায় রাজারবাগ দরবারের পীর দিল্লুর রহমানসহ তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা চাইলে মামলা করতে পারবেন বলে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলোর তদন্ত চলাকালে পীর ও তার অনুসারীদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবেন বলেও আদেশ দেওয়া হয়েছে। 

দুদককে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলে আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি মামলার শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।

এর আগে রাজধানীর শান্তিবাগ এলাকার বাসিন্দা একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ‘অস্তিত্বহীন’ বাদীর করা ৪৯ মামলার প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়। এর প্রেক্ষিতে গত ১২ সেপ্টেম্বর সিআইডি’র দাখিল করা প্রতিবেদনে ব্যবসায়ী একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, মানবপাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৪৯টি ভুয়া মামলার নেপথ্যে রাজারবাগের কথিত পীর দিল্লুর রহমানের নাম উঠে আসে। 

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) হাইকোর্টে ওই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদন জমা দেন সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার রতন কৃঞ্চ নাথ। প্রতিবেদন দাখিলের পর মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির নেপথ্যে পীরের কারসাজির তথ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। পরে আরও আট ভুক্তভোগী আরেকটি রিট দায়ের করেন।

হাইকোর্টের নির্দেশে রাজারবাগ পীর ও অনুসারীদের জঙ্গি সম্পৃক্ততা নিয়ে তদন্তে নামেন সিটিটিসি’র কাউন্টার টেরোরিজম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সহকারি পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম। তদন্ত শেষে হাইকোর্টে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

গত ২ ডিসেম্বর পীর দিল্লুর রহমানসহ চারজনের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চেয়ে হাইকোর্টে সম্পূরক রিট আবেদন দায়ের করা হয়। অন্য তিনজন হলেন- শাকিরুল কবির, ফারুকুর রহমান ও মফিজুল ইসলাম। ব্যবসায়ী একরামুল আহসান কাঞ্চন-এর পক্ষে অ্যাডভোকেট এমাদুল হক বশির সম্পূরক এ রিট আবেদন দায়ের করেন।

বিভি/এসডি

মন্তব্য করুন: