অরাজনৈতিক গবিতে ছাত্রদলের কমিটি: প্রশ্নের মুখে নীতি

গণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
২৬ বছর ধরে 'অরাজনৈতিক' পরিচয়ে পরিচালিত গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে (গবি) হঠাৎই ছাত্র রাজনীতির ছায়া। যেখানে শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রক্রিয়াতেই দলীয় রাজনীতি থেকে বিরত থাকার লিখিত অঙ্গীকার বাধ্যতামূলক, সেখানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল (ছাত্রদল) সম্প্রতি ‘গণ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা’র নামে ১২ সদস্যের একটি আংশিক কমিটি ঘোষণা করে জন্ম দিয়েছে তীব্র বিতর্কের। প্রশ্ন উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি, প্রশাসনের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ ক্যাম্পাস সংস্কৃতি নিয়ে।
গত ১১ জুন ছাত্রদলের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মো. আবু হোরায়রা ও সাধারণ সম্পাদক এম. রাজিবুল ইসলাম তালুকদার বিন্দুর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ‘গণ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল’ নামে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়।
ঘোষিত কমিটিতে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নির্জনকে সভাপতি ও মো. আসাদুর রহমান বিজয়কে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সিনিয়র সহসভাপতি মো. মামুন হোসেন খান, সহসভাপতি আব্দুল্লাহ আল রাফি ও মো. রাকিবুল হাসান, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মো. আব্দুল্লাহ আল রাইভার, যুগ্ম সম্পাদক মো. আকরাম হোসেন, মাশরুর মাহমুদ, মেহেদী হাসান ও রওনক জাহান রওনক, সাংগঠনিক সম্পাদক সবুজ আহমদ এবং দপ্তর সম্পাদক উল্লাস কুমার দত্ত আকাশও কমিটিতে রয়েছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এক বছরের জন্য এই কমিটি অনুমোদিত হয়েছে এবং ১৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় দপ্তরে জমা দিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো ছাত্ররাজনৈতিক সংগঠন প্রকাশ্যে কমিটি ঘোষণা করল। শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, পূর্বে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ বা ইসলামী ছাত্রশিবির গোপনে সীমিতভাবে সক্রিয় থাকলেও খোলাখুলিভাবে সংগঠনের নাম ব্যবহার করে কমিটি গঠনের নজির নেই।
গবির প্রসপেক্টাস অনুযায়ী, এটি একটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীরা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনে সম্পৃক্ত হতে পারবে না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম-লোগো ব্যবহার করে রাজনৈতিক সংগঠন গঠন করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ভর্তি নির্দেশনাতেও স্পষ্টভাবে বলা রয়েছে, "প্রসপেক্টাস বুঝে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে ইচ্ছুক।"
সম্প্রতি ১৯ মার্চ এক বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবারও জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে এর নাম বা লোগো ব্যবহার করে দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং এর ব্যত্যয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে শিক্ষার্থীদের দাবি, বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ও ইসলামী ছাত্র শিবির গোপনে বা অন্য মোড়কে সক্রিয় থাকলেও প্রকাশ্যে নাম বা কমিটি ঘোষণা করেনি। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকেই ছাত্রদলের তৎপরতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ও লোগো ব্যবহার করে ক্যাম্পাসের বাইরেও প্রচারণামূলক ও বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে আসছিল সংগঠনটি। এবার তারা প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে কমিটি ঘোষণা করলো।
নবঘোষিত কমিটির সভাপতি মো. নির্জন বলেন, “১২ জনের সম্মতিতে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা ক্যাম্পাসের ভেতরে কোনো কর্মসূচি করি না। আমাদের ছাড়াও আরও অনেক সংগঠন নানা ধরনের কাজ করে থাকে। তাহলে শুধু আমাদের কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন উঠলে সেটিকে বৈষম্যমূলক মনে করা যেতে পারে।"
প্রশাসনের সঙ্গে এখনো আলোচনা হয়নি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “প্রশাসন অনেক বিষয়েই আগ্রহ দেখায় না, তাই বলে কি আমাদের ব্যক্তিগত অধিকার থাকবে না? যদি শাস্তি দেয়, তখন দেখা যাবে।”
ছাত্রদলের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক এম রাজিবুল ইসলাম তালুকদার (বিন্দু) বলেন, "রাজনীতি নিষিদ্ধ’ এই ধারণার সঙ্গে আমি একমত নই। সংবিধানের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদের ক অথবা ঘ তে বলা আছে, রাজনীতি বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী আমরা ক্যাম্পাসের বাইরে রাজনীতি করি, শিক্ষার পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থেই।"
তিনি আরও বলেন, “বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ট্রাস্ট অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের মতো চলে, অতিরিক্ত ফি বা অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ছাত্রদের অধিকার। ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে তারা একতরফাভাবে আইন করেছে। আমরা হাইকোর্টে রিট করেও ন্যায্যতা চাইতে পারি, কিন্তু শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট না করার জন্যই তা করিনি। কেউ যদি ছাত্র রাজনীতির কারণে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, আমরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হবো। ভর্তির সময় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ফর্মে লেখা থাকে না যে রাজনীতি করা যাবে না।"
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই ঘটনায় স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন বলেন, “গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। এ সংক্রান্ত নির্দেশনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাসঙ্গিক নীতিমালায় এবং প্রসপেক্টাসে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুনরায় একটি নোটিশ জারি করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে কিংবা বাহিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে কোনো দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, নোটিশ প্রদানের পরও যদি কোনো সংগঠন বা ব্যক্তি রাজনৈতিক কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে, তাহলে তা স্পষ্টভাবে নীতিমালার লঙ্ঘন। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।”
ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার পর সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয়েছে সমালোচনার ঝড়। কেউ লিখেছেন, “গণ বিশ্ববিদ্যালয় কি তবে আর অরাজনৈতিক থাকলো না? প্রশাসন শুধু কাগজে কলমেই কি নিয়ম রাখবে?, আরেকজন মন্তব্য করেছেন, সাম্প্রতিক নোটিশেই তো বলা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ। তাহলে প্রশাসন কী ব্যবস্থা নেবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।”
প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নীতিতে গণ বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনীতি-মুক্ত রাখা হয়। ২০১৩ সালে নেতৃত্ব বিকাশ ও মত প্রকাশের সুযোগ রাখতে চালু হয় ছাত্র সংসদ, যার সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৮ সালে।
বর্তমানে ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতা, ডিবেটিং সোসাইটি, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, ক্যারিয়ার ক্লাব, সাংস্কৃতিকসহ বেশ কিছু সংগঠন সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: