কলঙ্কের ছায়া বুটেক্সে: খেলাকেন্দ্রিক সংঘাতে উত্তেজনা
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) স্পোর্টস ক্লাব আয়োজিত ফুটবল ফিয়েস্তা ২.০–এর ফাইনালে টাইব্রেকারে ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকে পরাজিত করে টেক্সটাইল ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন (টিএফডি) বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তবে এই প্রতিযোগিতাকে ঘিরে গত কয়েক দিনে ধারাবাহিক সংঘর্ষ, সিনিয়র–জুনিয়র কোন্দল এবং সাংবাদিকদের কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।
ঘটনার শুরু ৩ নভেম্বর (রবিবার) সেমিফাইনাল ম্যাচে ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও টেক্সটাইল মেশিনারিজ ডিজাইন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স (টিএমডিএম) বিভাগের খেলায়। খেলার শেষ মুহূর্তে বাঁশি বাজানোকে কেন্দ্র করে টিএমডিএম বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফয়সালের সঙ্গে ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের হাতাহাতি হয়। এসময় ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৫০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাকিবের গায়ে হাত তোলা হয়। পরে ফয়সাল দুঃখ প্রকাশ করলেও দুই বিভাগের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়, যা ফাইনালের দিন পর্যন্ত গড়ায়।
৪ নভেম্বর (মঙ্গলবার) অনুষ্ঠিত ফাইনালে নির্ধারিত সময়ের খেলায় সমতা থাকায় ম্যাচটি গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের শেষ মুহূর্তে ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কিছু দর্শক টিএফডি বিভাগের খেলোয়াড় ও ৫০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রাফিদের ওপর হামলা চালায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ফেব্রিক বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আসির প্রথমে রাফিদকে ঘুষি মারে, পরে একই বিভাগের ৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী বর্ষণও তাতে অংশ নেয়। এতে রাফিদ মাটিতে পড়ে গেলে দর্শকসারিতে হাতাহাতি ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। একই ঘটনায় ৪৭তম ব্যাচের একাধিক শিক্ষার্থী আহত হয় এবং হামলাকারী হিসেবে ৪৯তম ব্যাচের আল ফাহিম ও একই ব্যাচের কাইয়ুমের নামে অভিযোগ করে কিছু শিক্ষার্থী। তাছাড়া গুঞ্জন রয়েছে হামলাকারী ৪৯তম ব্যাচের আসির এনসিপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
তবে পাল্টা অভিযোগ করে আল ফাহিম জানায়, আগের দিনের ঝামেলার রেশ ধরে টিএমডিএম বিভাগের কিছু শিক্ষার্থীসহ কিছু বড় ভাইরা আমাকে টার্গেট করে রেখেছিল এবং ঘটনার সময় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাকে আঘাত করে।
পরবর্তীতে শিক্ষকদের তৎপরতায় পরিস্থিতি শান্ত হয় এবং পরে বৈঠকের মাধ্যমে ম্যাচ পুনরায় শুরু হয়। টাইব্রেকারে টিএফডি বিভাগ বিজয় অর্জন করে।
ঘটনাস্থলে ভিডিও ধারণ করতে গেলে বুটেক্স সাংবাদিক সমিতির সদস্য তারেক রহমান ও শেফাক মাহমুদের ওপরও কিছু শিক্ষার্থী চড়াও হন। এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (ইএসই) বিভাগের ৪৭তম বিভাগের শিক্ষার্থী আল মাহমুদ বিন কবির নির্ঝর, বুটেক্স সাংবাদিক সমিতির সদস্য এবং দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি শেফাক মাহমুদের দিকে তেড়ে আসলে, শেফাকের সহপাঠী অভিষেক তাকে থামায়। নির্ঝর অভিযোগ করেন, তখন তার কলার টেনে ধরেন অভিষেক।
পরদিন ৫ নভেম্বর (বুধবার) নির্ঝর প্রকাশ্যে অভিষেকের গায়ে হাত তোলেন এবং জোরপূর্বক ক্ষমা চাওয়ানো হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় ৪৭তম ব্যাচের আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী—টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মৃদুল ও টিএমডিএম বিভাগের রাফির নামও উঠে আসে।
ঘটনার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। সিনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ফাইনালের সময় জুনিয়ররা সিনিয়রদের প্রতি অশোভন আচরণ করেছে এবং গায়ে হাত তোলা হয়েছে, যা নিয়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে, জুনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, আগের সেমিফাইনালের ঘটনার জেরে কিছু সিনিয়র আগেই প্রতিশোধমূলক হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং রাতে এক বৈঠকে উভয় পক্ষের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হন। প্রশাসন আশ্বাস দেয়, তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক অধ্যাপক ড. মো. জুলহাস উদ্দিন বলেন,“এই ঘটনাগুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অত্যন্ত হতাশ। টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাধারণত ভদ্র ও গুণী হন, কিন্তু একটি খেলা নিয়ে এমন আচরণ তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। শিক্ষকরা মাঠে উপস্থিত থাকায় বড় দুর্ঘটনা এড়ানো গেছে।”
তিনি আরও বলেন,“মারামারি কোনো সমাধান নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম ও প্রবিধান সবার জন্য সমান। সিনিয়রদের উচিত সহনশীলতা দেখানো এবং এমন পরিবেশ তৈরি করা যাতে জুনিয়ররা শ্রদ্ধা করতে শেখে।”
উপাচার্য জানান, ঘটনাগুলো তদন্তে দুটি পৃথক কমিটি কাজ করছে এবং আগামী রবিবার ডিসিপ্লিনারি বোর্ড বসবে। "যারা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে, তাদের ইতোমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশাসন সম্পূর্ণ সচেতন আছে—কেউ আইনের বাইরে নয়,” বলেন তিনি।
প্রক্টরিয়াল টিম সূত্রে জানা গেছে, ঘটনাগুলোর লিখিত অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দুটি আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। উভয় ঘটনার তদন্ত চলছে এবং প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিভি/এজেড




মন্তব্য করুন: