কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বিভ্রাটের স্থায়ী সমাধান চায় শিক্ষার্থীরা
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কালো তালিকাভুক্ত দেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ২৬ তম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের মিল থাকায় বিভিন্ন সময়ই ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। এজন্য উচ্চশিক্ষা, বিদেশ গমন, চাকরির ক্ষেত্রসহ বিভিন্ন জায়গায় হয়রানির শিকার হওয়াসহ প্রায়ই নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভাবমূর্তি সংকটে পড়েন তারা। প্রতিবারই কর্তৃপক্ষ এ সংকটকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলে চালিয়ে আসলেও তা স্থায়ী সমাধানের দিকে এগোয়নি কখনও তারা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, সংশ্লিষ্টরা উদ্যোগ নিলে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৫ সালের ৪ ডিসেম্বর সরকার থেকে অনুমোদন লাভ করে ‘দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা’ নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ২০০৬ সালে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়টি কালো তালিকাভুক্ত করে। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান কুমিল্লা শহরের হাউজিংয়ে থাকলেও মঞ্জুরি কমিশনের ওয়েবসাইটে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান ঢাকার উত্তরায় লেখা রয়েছে। যদিও সম্প্রতি এ জায়গাটি পরিদর্শন করেও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি বলে জানিয়েছে মঞ্জুরি কমিশন।
এদিকে ২০০৬ সালে ২৬ মে দেশের ২৬ তম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মো. মোশারফ হোসেন। বর্তমানে তিনি সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত। তাঁর সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৭ সালে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করার দু’-তিন বছরের মধ্যেই একটি সনদের সত্যতা যাচাই করতে বিদেশি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু কাগজপত্র আসে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদিও এ সময়ের মধ্যে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো ডিগ্রীধারী বের হননি। সেসময় কুবি কর্তৃপক্ষ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে চিঠির মাধ্যমে জানায় যে, এ কাগজপত্রগুলো ‘দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা’ নামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ নামে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজপত্র কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রেরণ না করার অনুরোধ করে কুবি কর্তৃপক্ষ।
বিড়ম্বনার সূত্রপাত তখন থেকেই। সেসময় কুমিল্লা শহরের হাউজিংয়ে অবস্থিত ‘দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা’ নামের বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করার জন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির সেসময়কার শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে বলে জানান কুবির প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বর্তমান শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ। তিনি বলেন, ‘একই নামে একই শহরে একটি প্রাইভেট ও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকায় বিব্রতকর সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে নিজেদের ক্যাম্পাস ঢাকায় স্থানান্তর করে ‘দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা’ কর্তৃপক্ষ।’
এরপরও নামের মিল থাকার কারণে বিভিন্ন সময়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ যুক্তরাজ্যের ‘ইউনিভার্সিটি ফর দি ক্রিয়েটিভ আর্টস’ বা ইউসিএ নামের বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করেছে বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে কয়েকটি গণমাধ্যম। যদিও এ সংবাদ মাধ্যমগুলো ইউসিএ কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য তাদের সংবাদে তুলে ধরতে পারেনি। এছাড়া ইউসিএর ওয়েবসাইটে গিয়েও নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সংবাদে প্রকাশিত কালো তালিকাভুক্ত পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটির ইংরেজি বানান ‘The University of Cumillah’ আরেকটির ‘Cumilla University’। পক্ষান্তরে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির নামের ইংরেজি বানান ‘Comilla University’। কালো তালিকাভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নামের বানানের সাথে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির নামের বানানে মিল না থাকায় এটি নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় নয় বলে জানিয়েছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড এ এফ এম আবদুল মঈন। তিনি বলেন, ‘তালিকার দুটি নামের কোনটির বানানই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের বানানের সাথে মিল নেই। এ বিষয়ে কারও দুশ্চিন্তা করারও দরকার নেই।’
বিষয়টি স্পষ্ট করতে ইতিমধ্যে ইউসিএ কর্তৃপক্ষকে চিঠিও দিয়েছেন কুবি উপাচার্য। এছাড়া পৃথক আরেকটি বার্তায় কুবির সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ ধরনের ‘গুজব’ এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এর আগে গেলো বছরের মাঝামাঝিতে কানাডা ভিত্তিক একটি ওয়েবসাইট ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডেনশিয়াল ইভালুয়েশন সার্ভিস (আইসিইএস) বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদধারীরা কানাডায় উচ্চশিক্ষার জন্য মূল্যায়নের যোগ্যতা হারিয়েছে উল্লেখ করে একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেখানেও একমাত্র সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আসে। তবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউজিসি সংশ্লিষ্টরা বলেছিল এটি ‘দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা’ নামক রাজধানীর অননুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সেসময় ইউজিসি সদস্য ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক দিল আফরোজ বেগম একটি অনলাইন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রকাশিত তালিকায় কুমিল্লা ইউনিভার্সিটি নামে যে বিশ্ববিদ্যালয়টি এসেছে তা মূলত ঢাকার উত্তরার ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা, যেটি ইউজিসির কালো তালিকাভুক্ত একটি বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তাই এ বিষয়ে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীর উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’
এসব ঘটনা প্রতিবারই ‘নামবিভ্রাটের কারণে ঘটছে’ বলে আসছে কর্তৃপক্ষ। তবে এর স্থায়ী সমাধান চাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, কিছুদিন পরপর এ ধরনের ঘটনা তাদের জন্য বিব্রতকর। আব্দুর রহমান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এবারের ঘটনাটিও হয়তোবা সমাধান চলে আসবে। কিন্তু কতবার আপনি সমাধান দিবেন। একই নামের দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এখনি উপসংহারে আসা উচিৎ।’
এদিকে প্রতিবছরই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষার আগে ‘দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা’ নামের বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে পরামর্শ দিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। এবারও বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মঞ্জুরি কমিশন বলে, তারা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায় গিয়ে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে পায়নি। তাহলে ‘নামসর্বস্ব’ এ বিশ্ববিদ্যালয়টি কেন একেবারেই বন্ধ করছে না সরকার- এমন প্রশ্ন করেছেন অনেকই।
আবু বকর নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ইউজিসিই যেহেতু ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছে না, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়টি জিইয়ে না রেখে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে না কেন। এতে বরং জটিলতা তৈরি হচ্ছে।’
প্রশ্নটি করা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক জামিনুর রহমানকে। তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
একই প্রশ্নে কমিশনের সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজ বেগম বলেন, ‘আমরা শুধুমাত্র শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাইলে কোনো রিপোর্ট দিতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে পারি না। এ এখতেয়ার আমাদের নেই। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সঠিক ব্যখ্যা দিতে পারবে।’
তবে মঞ্জুরি কমিশনের সচিব ফেরদৌস জামান বলেন, ‘এ বিষয়ে নীতিনির্ধারকেরা সবাই একসাথে বসলে ভালো কোন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব। এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া যায় না।’
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীককেও একই প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয়টির অনুমোদন অনেক আগেই বাতিল করা হয়েছে। আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তো কর্তৃপক্ষকে চিহ্নিত করতে হবে। তাদেরকেই তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
তাহলে কি ‘নাম বিভ্রাট’র এ সংকট চলতেই থাকবে? এমন প্রশ্ন করা হলে বিষয়টি এড়িয়ে যান আবু বকর ছিদ্দীক।
এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে হবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই। বিষয়টি মানছেনও উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ. এফ. এম. আবদুল মঈন। তিনি বলেন, সমস্যাটি নিয়ে ইতিমধ্যে আমরা বিভিন্ন জায়গায় কথা বলেছি। স্থায়ী সমাধানের বিষয়েও আমরা সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় কথা বলবো।
বিভি/রিসি
মন্তব্য করুন: