বিপত্তি ডিঙিয়ে রাজনীতি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সফল রংপুরের রানী
আনোয়ারা ইসলাম রানী
রংপুর-৩ আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনায় এলেও আগে থেকেই দীর্ঘদিন ধরে হিজড়া জনগোষ্ঠির মানুষের জন্য কাজ করেছেন আনোয়ারা ইসলাম রানী। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টার পাশাপাশি রূপান্তরের ব্যানারে এসব মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন রানী।
হিজড়া জনগোষ্ঠির উন্নয়েন নিবেদিত রানী বলেন, এখনও নিজেকে সফল উদ্যোক্তা মনে করি না। চেষ্টা করে যাচ্ছি। রংপুরে ৩৯২ জন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য রয়েছেন। আমি সেদিনই নিজেকে সফল মনে করব যেদিন আমার পরিবারের ৩৯২ জনই ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখবে। ১৫০ জনকে সমাজসেবার মাধ্যমে চারটি প্রশিক্ষণ নেয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। সেখান থেকে ৩০ জন কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। প্রথমে তালিকা করেছি কোন সদস্য কোন কাজে পারদর্শী। তালিকা অনুযায়ী তাদের সেই প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর হস্তজাত শিল্পের রূপান্তর নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু করি। সেখানেও ২৪ জন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য কর্মসংস্থানে সম্পৃক্ত হয়েছেন। এখানে তারা স্থায়ী ও অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছেন।
রানী বলেন, এখন রাস্তাঘাটে ফুডকার্টের ব্যবসা শুরু হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরাও করছে। অনেক ভালো পরিবারের মানুষও করছে। এখানে যেহেতু খুব বেশি বিনিয়োগ লাগবে না, সুতরাং কিছু সুযোগ তৈরি হতে পারে। তখন ফুডকার্টের ব্যবসা চালু করলে সেখানেও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর চারজন কাজ করছে। এরা সবাই আগে পথেঘাটে মানুষের কাছে টাকা তুলে জীবিকা নির্বাহ করতো। এখন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সবাই সমাজের মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে।
হিজড়াদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিভিন্ন বাধা বিপত্তির বিষয়ে আনোয়ারা ইসলাম রানী বলেন, কোথাও কেনাকাটা করতে গেলে কেউ হয়তো ভয় পাচ্ছে আমাদের দিতে চাচ্ছে না, পরে অনেক বুঝিয়ে নিতে হয়। ক্রেতারাও অনেক সময় ভয় পায়, ওখানে গেলে কি না কি হবে। সমাজের মানুষের মধ্যে এ ধরনের ভয় এখনও কাজ করে। ধীরে ধীরে সবার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে। আমরা সবাই চেষ্টা করছি, পরিবর্তন হওয়ার। আমি সমাজের মানুষকেও অনুরোধ করব, যেন দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে আমাদের গ্রহণ করে। আমরা যেন অন্য দশ জনের মত জীবন অতিবাহিত করতে পারি।
রানীর প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক হিজড়া জানান, একসময় মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলেই আমরা জীবিকা নির্বাহ করতাম। কিন্তু রানী আপার কারণে আমরা এখন কর্মসংস্থান পেয়েছি। চাঁদা তুলে খেতে হয় না, কাজ করেই খাই। এটি আমাদের জন্য অনেক মর্যাদার।
রংপুর সিটি করপোরেশনের আংশিক ও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত রংপুর-৩ আসনে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর আনোয়ারা ইসলাম রানী। ভোটের মাঠসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে রাণী বলেন, আমার মাথায় আসলো সারাজীবন কেন এই জনগোষ্ঠী পিছিয়ে থাকবে। আমি দেওয়ালটা ভেঙে দিতে চেয়েছিলাম। আমরাও এ দেশের সর্বোচ্চ পদের জন্য নির্বাচন করব। আমি নির্বাচিত না হলেও পরবর্তী প্রজন্মের কেউ না কেউ যেন নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন না থাকে সে পথ এখন খুলে গেল। আমি মনে করি একটা সময় আমার মতো কেউ না কেউ একদিন সেই পদে গিয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে মানুষের কল্যাণে কাজ করবে।
রানী বলেন, মানুষের ধারণা ছিল হিজড়ারা হয়তো পারবে না, আমার রাজনীতি করার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কোনো দলের সঙ্গেও কখনো সম্পৃক্ত ছিলাম না। রাজনীতিও ভালো মতো বুঝিও না। আমি হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে দেড়-দুই মাসের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি।
রাণী বলেন, হিজড়া জনগোষ্ঠির প্রতি মানুষের এখনও সমাজে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। মানুষের মাঝে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়লেও সর্বত্র সেটি জোরালো হয়নি। ফলে সমাজ ও পরিবারের বাধায় সবসময় পিছিয়ে থাকেন অনেক হিজড়া। ছোটবেলায় বাবার দিক থেকে বাধা আসত, আত্মীয়-স্বজন অনেকেই মেনে নিতে চাইত না। সেগুলো একটা সময় ছিল। সেসব পার করেই এসেছি। এখন ধীরে ধীরে সব মানিয়ে নিয়েছি। পরিবারের সঙ্গেই থাকছি। আমি আমার নিজের পরিবারকে নিয়েও থাকি। আমার যে কমিউনিটির মানুষ আমি সেই পরিবারকে নিয়েও থাকি। দুই পরিবারকে একসঙ্গে নিয়েই থাকি।
তবে হিজড়া সম্প্রদায়কে মানুষ এখন গ্রহণ করা শুরু করেছে বলে জানান রানী। তিনি বলেন, নির্বাচনে ২৪ হাজার মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছে রাণীকে। আমি মনে করি যে সব সমস্যা শেষ হয়ে একদিন আমরা মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারব।
হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের উদ্দেশে রানী বলেন, তাদের সবার ভেতরেই কোনো না কোনো প্রতিভা আছে। সবাইকে নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। অবশ্যই বাধা আসবে, তবে বাধা অতিক্রম করতে হবে। যেন কোনো বাধায় আমার সম্প্রদায়ের লোকরা থেমে না যায় সে আহবান করবো সবাইকে।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: