• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

দেশেই ২০ হাজার টাকায় রোবটের মাধ্যমে হার্টে রিং পরানোর সেবা 

শুভ ইসলাম

প্রকাশিত: ১৫:১৭, ২৪ জানুয়ারি ২০২৪

আপডেট: ১৫:৫০, ২৪ জানুয়ারি ২০২৪

ফন্ট সাইজ
দেশেই ২০ হাজার টাকায় রোবটের মাধ্যমে হার্টে রিং পরানোর সেবা 

রবিবার (২১ জানুয়ারী) বাংলাদেশের একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের দুইজন হৃদরোগ আক্রান্ত রোগীর প্রধান ধমনীতে বিনামূল্যে রোবটিক পদ্ধতিতে রিং পরানোর মাধ্যমে রোবোটিক সেবার যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে I

কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেছেন এই প্রতিষ্ঠানের সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার প্রদীপ কুমার কর্মকার ও তার বিশেষায়িত টিম এবং এই চিকিৎসা পদ্ধতিটির উদ্বোধন করেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা: মোঃ কামরুল হাসান মিলন ও কার্ডিলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা: মোঃ সালাউদ্দিন। 

রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি যে কোন দেশের জন্য যুগান্তকারী ও সর্বাধুনিক হৃদরোগ চিকিৎসা পদ্ধতি I এই পদ্ধতিতে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোনো চিকিৎসা সেবা দেয়া হলো I

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সহ বিশ্বে ১৬০ টি দেশে রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি ( রোবট দিয়ে হার্টের রিং পরানো) সেন্টার রয়েছে এর মধ্যে ভারতের ছয়টি সেন্টার রয়েছে i এই চিকিৎসার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল রোবোটিক যুগে পদার্পণ করলো I

রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি বর্তমান পৃথিবীতে হার্টের রিং পরানোর সর্বাধুনিক এবং সর্বশেষ প্রযুক্তি I কার্ডিওলজিস্টরা এখনো ক্যাথল্যাবে নিজেরা রোগীর কাছ থেকে রোগীদের হার্টের রিং পরান I এর সর্বশেষ আবিষ্কার হলো রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি অর্থাৎ রোবট দিয়ে হার্টের রিং পরানো I 
এর মাধ্যমে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা রোগীর চেয়ে দূরে থেকে নিখুঁতভাবে হৃদরোগীদের হার্টের ধমনীতে রিং পরান I এই রোবটের দুটি অংশ থাকে একটি হলো রোবটের একটি হাত যা ক্যাথল্যাবে থাকে I আরেকটি থাকে কন্ট্রোল সেকশন যেখান থেকে মূল কার্ডিওলজিস্ট পুরো রিং পরানো কার্যক্রমটি দূর থেকে সম্পন্ন করে থাকেন I

রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি বা রোবট দিয়ে হার্টের রিং পরানোর তিন ধরনের সুবিধা আছে একটি হলো রোগীর জন্য সুবিধা আরেকটি হলো কার্ডিওলজিস্ট যিনি রিং পরান তার জন্য সুবিধা এবং তৃতীয় হল দেশের জন্য সুবিধা I

রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির প্রথম সুবিধা হল হার্টের রিং পরানোর জটিল প্রক্রিয়াটি রোবটের মাধ্যমে খুব সূক্ষ্ম ও নিখুঁতভাবে করা যায় I অনেক সময় হার্টের রিং নিখুঁতভাবে পজিশন করার জন্য এক মিলিমিটার সামনে অথবা এক মিলিমিটার পিছনে নেওয়ার প্রয়োজন হয় কিন্তু হাত দিয়ে করলে নিখুঁতভাবে এই কাজটি করা কঠিন হয় কিন্তু রোবটের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে এটি সম্পন্ন করা যায় I রোগীদের জন্য আরেকটি সুবিধা হল হৃদরোগ চিকিৎসকগণ সরাসরি এনজিওপ্লাস্টি করতে গেলে যে সময় লাগে রোবটের মাধ্যমে সেটি করতে অনেক কম সময় লাগে যেই কারণে অল্প সময়ে বেশি রোগীর চিকিৎসা সেবা দেয়া যায় I হার্টের ভিতরে ক্যাথেটার, ওয়্যার(তার), বেলুন, রিং যত কম সময় রাখা যায় রোগীর জন্য তত নিরাপদ তাই রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে রিং পরাতে সময় কম লাগে বলে জটিলতা ও কম হয় I

রোবটিক এনজিওপ্লাস্টিতে চিকিৎসকদের জন্য সুবিধা হল যেসব চিকিৎসক অনেক এনজিওপ্লাস্টি করেন একটা সময় এসে তারা দুটি সমস্যায় পড়েন প্রথমত হল রেডিয়েশনের কারণে অনেক চিকিৎসক ব্রেন ক্যান্সার ও চোখে ক্যাটারাক্ট সহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার ঝুঁকিতে পড়া I এছাড়া হৃদরোগ চিকিৎসকগণ যখন অপারেশন থিয়েটার বা ক্যাথলেবে কাজ করেন রেডিয়েশন প্রটেকশন এর জন্য তারা ১২ থেকে ১৫ পাউন্ড ওজনের একটি বিশেষ জামা দীর্ঘক্ষন যাবত পরতে হয় ফলে ঘাড়ের নার্ভের চাপ পড়ে এবং পরবর্তীতে চিকিৎসক খুব বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘাড় ও হাতে ব্যথার কারণেএনজিওপ্লাস্টি করতে পারেন না I বর্তমানে অনেক সিনিয়র ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট এই সমস্যার জন্য চিকিৎসা সেবা দিতে পারছেন না I এক্ষেত্রে রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে রেডিয়েশন ছাড়াই এবং ভারী বিশেষ জামা পড়া ছাড়াই ক্যাথল্যাবের কন্ট্রোলরুমে, তার অফিসে, সুযোগ-সুবিধা থাকলে বাসায় বসে অথবা দেশের বাইরে থেকেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে হার্টের রিং পরাতে পারবেন I

দেশের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হল অত্যাধুনিক এই চিকিৎসা প্রযুক্তি চালু হলে রোগীকে আর দেশের বাইরে যেতে হবে না I রোবটিক চিকিৎসার জন্য প্রতিবছর অসংখ্য লোক ভারত, সিঙ্গাপুর সহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন I আমরা যদি সেবাটি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পরিপূর্ণভাবে চালু করতে পারি তাহলে খুব কম খরচে রোগীদের এই সেবা দেয়া যাবে এবং এর মাধ্যমে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে এবং অনেক বড় অংকর একটি অর্থ দেশে থেকে যাবে I

রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি চালুর মাধ্যমে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সর্বাধুনিক ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে। বর্তমান মেশিনটি একমাস ব্যবহারের জন্য ফ্রান্স থেকে নিয়ে আসা হয়েছে বাংলাদেশে অবকাঠামো সাথে সহায়ক কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য I একমাস পরে আবার ফেরত চলে যাবে ফ্রান্সে I যদি রোবটিক সিস্টেমটি বাংলাদেশের অবকাঠামোর সাথে সহায়ক হয় তাহলে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল এই রোবটিক সিস্টেমটি কেনার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করবে এবং খুব কম খরচে আন্তর্জাতিক সর্বাধুনিক এই প্রযুক্তি সব সময়ের জন্য জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চালু রাখতে পারবে I এভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ডিজিটালাইজ পদ্ধতির ব্যবহার করার সুযোগ পাবে I

বাংলাদেশের এখনো সরকারি ও বেসরকারি কোন হাসপাতালে রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি শুরু হয়নি, ডাক্তার প্রদীপ কুমার কর্মকার দেশের প্রথম চিকিৎসক যিনি এই রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির এর উপর ট্রেনিং নিয়েছেন I যদি সরকার এই রোবটিক সিস্টেমটি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে সরবরাহ করে তবে ডাক্তার প্রদীপ কুমার কর্মকার ও তার দক্ষ টিম পরিপূর্ণভাবে সর্বসময় জন্য সর্বাধুনিক এই চিকিৎসা পদ্ধতি বাংলাদেশের জনগণকে স্বাস্থ্য সেবা দিতে পারবে I

সরকারি হাসপাতালে ওষুধ সহ প্রায় অধিকাংশ যন্ত্রপাতি সরকার সরবরাহ করে I এক্ষেত্রে রোবটিক এনজিওপ্লাস্টিতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি যদি সরকার সরবরাহ করে তবে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের চিকিৎসকৃন্দ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে রোবটের মাধ্যমে হৃদরোগীদের হার্টের রিং পরানো এই অত্যাধুনিক স্বাস্থ্যসেবাটি দিতে পারবেন I এখানে উল্লেখ করা যায়, যে সরকার বহুলাংশে এনজিওগ্রামে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও এনজিওপ্লাস্টিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং রিং বিনামূল্যে সরবরাহ করছে I রোবটিক এনজিওপ্লাস্টিক চালু করতে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের যথেষ্ট অবকাঠামো রয়েছে অত্যাধুনিক ক্যাথল্যাব, দক্ষ প্রশিক্ষিত চিকিৎসক রয়েছে I

রোবটের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহু আগেই শুরু হয়েছে যেমন স্পাইনাল সার্জারিতে এটা ইতিমধ্যে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত I রোবটিক করোনারি আটারি বাইপাস গ্রাফ্ট বা সিএবিজি আমাদের পাশের দেশ ভারতে হচ্ছে সিঙ্গাপুরে হচ্ছে I 

এছাড়া অনেক উন্নত দেশেই হচ্ছে I নিখুঁতভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং অপারেশন জটিলতা কম হওয়ায় রোগী ও ডাক্তারদের প্রথম পছন্দ রোবটের মাধ্যমে অপারেশন করা I তাই পৃথিবী জুড়ে এই চিকিৎসা পদ্ধতি দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে I ভারতে প্রথম শুরু হয় ১৯১৮ সালে অধ্যাপক তেজেশ প্যাটেল এটা শুরু করেন I তিনি যখন প্রথম রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি করেন তখন তিনি তার থেকে প্রায় বত্রিশ কিলোমিটার দূরে এক রোগীর হার্টের রিং পরান I তখন থেকে এটি সারা বিশ্বে শুরু হয় এবং এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলছে, প্রতিনিয়ত গবেষণা এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি এর সাথে সংযুক্ত হচ্ছে I

ডাক্তার প্রদীপ কুমার কর্মকার এর আগেও বাংলাদেশের প্রথম বারের মত কোন সরকারি হাসপাতালে ট্রান্স ক্যাথেটার এউটিক ভাল্ব রিপ্লেসমেন্ট বা টিএভিআর পদ্ধতিতে বুক না কেটে হার্টের ভাল্ব প্রতিস্থাপন করেন I ২০২০ সালে তার নেতৃত্বে প্রথম জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে সফলভাবে এই অপারেশন সম্পন্ন হয় I এ পর্যন্ত ডাক্তার প্রদীপ কুমার কর্মকার বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগীর টিএভিআর পদ্ধতিতে এউটিক ভাল্ব প্রতিস্থাপন করেছেন I সম্প্রতি সরকারি হাসপাতালে প্রথমবারের মতো হার্ট অ্যাটাক ঘটিয়ে এইচ ও সি এম বা হাইপারট্রপিক অবস্ট্রাক্টিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি চিকিৎসা করেন I

বিভি/ এসআই

মন্তব্য করুন: