যেভাবে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধের সূচনা হয়েছিল

ছবি: সংগৃহীত
সালটা ১৯৫৩। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথ গোপন অভিযানে সিআইএ’র সহায়তায় ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এরপর, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইরানে পুতুল সরকার হিসেবে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে রাজগদিতে বসানো হয়। শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত। তিনি ইরানকে পশ্চিমা আধুনিকতার অনুকূলে রূপান্তর করে সেখান থেকে ইসলামের প্রভাব কমিয়ে আনতে চেষ্টা করেন। এমনকি তিনি সৌদি আরবকেও প্রাচীন চিন্তাধারায় আটকে না থেকে আধুনিক হওয়ার পরামর্শ দিতেন।
শাহ মোহাম্মদ পাহলভির রাজকীয় ভঙ্গি-আচরণ ও বিলাসবহুল জীবনযাত্রা দেখে ইরানের দরিদ্র জনগণের মনে গভীর ক্রোধ জন্ম নিতে শুরু করে। একই সময়, আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি তার বক্তৃতা দ্বারা ইরানের মানুষকে সচেতন করতে থাকেন। ফলে তাদের ভেতর প্রতিবাদের বীজ বপণ হতে শুরু হয়।
ইরানের মানুষের অসন্তোষ ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তাকে আশ্রয় প্রদান করে পশ্চিমারা। ১৯৭৯ সালে ইরানে এক বিশাল পরিবর্তন আসে। শাহের পতনের ভেতর দিয়ে ইসলামী বিপ্লব সূচিত হয় ইরানে। এদিকে ইরানে ফিরে আসেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। সেদিন পুরো জাতি তাকে স্বাগত জানাতে একত্রিত হয়। এমন বিশাল ভিড় আগে কেউ কখনো দেখেননি। ইরানে ফিরে এসে তিনি দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এদিকে শাহ মোহাম্মদ পাহলভিকে ফেরত দিতে তেহরানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের ৫২ জন মার্কিন নাগরিককে বন্দি বিনিময়ের জন্য আটক করা হয়। যদিও শাহ মোহাম্মদ পাহলভিকে ফেরত দেয়নি তারা।
১৯৮০ সালে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ১৯৮১ সালে রোনাল্ড রেগান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন বন্দি নাগরিকদের মুক্তি দেয় ইরান।
তবুও ইরানের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব বজায় রাখে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে সন্ত্রাসবাদে সহায়তাকারী দেশ বলে আখ্যা দেয়। ১৯৮৮ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘ভিনসেনস’ একটি ইরানি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করে। এসময় ২৯০ জন যাত্রী প্রাণ হারান।
২০০২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরানকে ‘অ্যাক্সিস অফ ইভিল’ বলে আখ্যা দেন। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স প্রকাশ করে যে, ইরান ফোর্ডো অঞ্চলে গোপনে একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র গড়ে তুলছে।
এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করে। এই ঘটনায় ইরান গভীরভাবে মর্মাহত হয়। এদিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বারবারই বলে আসছিলেন তারা পারমাণবিক বোমা তৈরিতে আগ্রহী নন।
এদিকে ইরানের প্রতি আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখাতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইসরাইল। তারা বিভিন্নভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইরানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাতে থাকে।
২০২৫ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিছুটা সমঝোতায় পৌঁছেছে ইরান। তবে ৬ জুন আবারও ট্রাম্প বলেন, যদি ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে, তাহলে তারা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এরপরই মধ্যপ্রাচ্যের ক্যান্সার খ্যাত ইসরাইল সরাসরি হামলা করে দেয় ইরানে। সময়ের সাথে সাথে এই সংঘাত আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে আত্মসমর্পণ করার হুঁশিয়ারি দেন। এছাড়া ট্রাম্প ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হত্যারও ইঙ্গিত দেন। তবে ট্রাম্পের ‘বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ’-এর প্রস্তাবকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেন খামেনি। তিনি স্পষ্টভাবে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যদি আমেরিকা ইসরাইলের সঙ্গে মিলে ইরানে সামরিক হামলা চালায়, তবে তার পরিণতি ভয়াবহ ও বিপর্যয়কর হবে।
বিভি/আইজে
মন্তব্য করুন: