পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের ছক এঁকেছিল ইসরাইল ও ভারত

ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তানের বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী আব্দুল কাদির খান একবার এএফপি সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি প্রথমবার দেশকে রক্ষা করেছিলাম যখন আমি পাকিস্তানকে একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে গড়ে তুলেছিলাম এবং আবারও দেশকে রক্ষা করি যখন আমি সমস্ত দায় স্বীকার করে নিজের ওপর নেই।’
বিশ্বব্যাপী ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনায় ছিলেন পাকিস্তানের পরমাণুবিজ্ঞানী আব্দুল কাদির খান। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর সাবেক প্রধান জর্জ টেনেট তাকে ওসামা বিন লাদেনের মতোই হুমকিস্বরূপ মনে করতেন। এমনকি ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক প্রধান শাবতাই শ্যাভিট তার হত্যাকাণ্ড না ঘটানোয় অনুশোচনা প্রকাশ করেছিলেন। আব্দুল কাদির খানের পারমানবিক কর্মসূচির আওতায় পাকিস্তান বিশ্বের সপ্তম পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঠেকাতে একাধিক গুপ্তহত্যা ও বোমা হামলা চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের বিরুদ্ধে। যদিও ইসরাইল নিজেও পারমাণবিক শক্তি অর্জন করেছে। তবে তারা কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে তা স্বীকার করেনি। ১৯৮০-এর দশকে ইসরাইল পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করে। এতে ভারতের সহায়তা চাওয়া হয়। পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির সাবেক কর্মকর্তা ফিরোজ খানের মতে, একটি মুসলিম দেশের কাছে পারমাণবিক বোমা থাকবে এটি চাইত না ইসরাইল।
পাকিস্তানের এই কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত ইউরোপের বিভিন্ন কোম্পানির কর্মকর্তারা মোসাদের হামলার টার্গেট হন। পশ্চিম জার্মানিতে লেটার বোমা ও সুইজারল্যান্ডে একটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ইতিহাসবিদ আদ্রিয়ান লেভি, ক্যাথরিন স্কট-ক্লার্ক এবং আদ্রিয়ান হ্যানি মনে করেন, পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা তৈরি থামাতে এসব প্রচেষ্টা চালিয়েছিল মোসাদ।
তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি তখনই নিজ দেশের জন্য পারমাণবিক শক্তি অর্জনের প্রতিজ্ঞা করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা ঘাস বা লতাপাতা খাব, এমনকি ক্ষুধার্ত থাকব, তবুও আমরা নিজেদের জন্য একটি পারমাণবিক বোমা তৈরি করব।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটি খ্রিষ্টান বোমা আছে, একটি ইহুদি বোমা আছে এবং এখন একটি হিন্দু বোমাও আছে। কেন একটি ইসলামিক বোমা থাকবে না?’
১৯৮০-এর দশকের শুরুতে ইসরাইল ভারতকে প্রস্তাব দেয় যে, পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনায় যৌথভাবে বোমা হামলা চালানো হবে। ইসরাইল এফ-১৫ ও এফ-১৬ যুদ্ধবিমান গুজরাটের জামনগর বিমানঘাঁটি থেকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানে হামলা চালানোর পরিকল্পনা সাজায়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রাথমিকভাবে এই অভিযানের অনুমোদন দিলেও, পরে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।
পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালেও রাজীব গান্ধী ও ভারতের তৎকালীন সেনাপ্রধান পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন। যুদ্ধ উসকে দিতে ভারত ৫ লাখ সেনা, শত শত ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান পাকিস্তান সীমান্তে মোতায়েন করে। ভারত ও ইসরাইলের বিরোধিতার মধ্যেই পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে গোপনে সহায়তা করেছিল চীন। পাকিস্তানকে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম, ট্রিটিয়াম ও বিজ্ঞানী সরবরাহ করতে থাকে চীন।
১৯৯৮ সালের ১১ মে ভারত পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। এরপর পাকিস্তানও বেলুচিস্তানের চাগাই মরুভূমিতে পাল্টা সফল পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। এই সাফল্যের অন্যতম স্থপতি আব্দুল কাদির খান জাতীয় বীর হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। আব্দুল কাদির খান আরও এক দুঃসাহসিক কাজ করেছিলেন। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি একটি আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নেটওয়ার্ক পরিচালনা করতেন, এসময় ইরান, উত্তর কোরিয়া ও লিবিয়ার মতো দেশগুলোতে পারমাণবিক প্রযুক্তি ও নকশা সরবরাহ করা হতো।
তবে লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি ২০০৩ সালে আব্দুল কাদির খানের গোপনে পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলেন। গাদ্দাফি তখন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অর্জনের চেষ্টা করছিলেন। গাদ্দাফি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং এমআই সিক্সের কাছে এও প্রকাশ করে দেন যে আব্দুল কাদির খান তার সরকারের জন্যও পারমাণবিক স্থাপনা তৈরি করছিলেন। কিছু মুরগির খামারের আড়ালে সেটি নির্মাণ করা হচ্ছিল।
বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী আব্দুল কাদির খান পশ্চিমা আধিপত্যের বিরোধিতা করে মুসলিম দেশগুলোর হাতে পারমাণবিক প্রযুক্তি তুলে দিতে আগ্রহী ছিলেন। তার এক ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, তিনি বিশ্বাস করতেন মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে এই প্রযুক্তি ভাগাভাগি করা অপরাধ নয়।
২০২১ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন বিশিষ্ট এই পরমাণুবিজ্ঞানী। ২০১৯ সালে আব্দুল কাদির খান একবার পাকিস্তানের জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘জাতিকে তিনি আশ্বস্ত করতে চান যে পাকিস্তান এখন একটি নিরাপদ পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। কেউ আর তাদের দিকে কুনজরে তাকাতে পারবে না।’
বিভি/আইজে
মন্তব্য করুন: