‘আদিবাসী নয়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’

ফাইল ছবি
বাংলাদেশ সরকারের নীতি অনুযায়ী, যারা আদিবাসী বলে দাবি করছে তারা এখানকার আদি বাসিন্দা নয়। তারা হচ্ছে এ ভূখণ্ডের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী।
সম্প্রতি বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রণালয় থেকে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, গণমাধ্যমে যাতে 'আদিবাসী' শব্দটি ব্যবহার না করা হয়। এবারই প্রথম নয়। বাংলাদেশ সরকার 'আদিবাসী' শব্দটির অস্তিত্বই স্বীকার করে না।
এ বিষয়ে সরকারের যুক্তি
শান্তি চুক্তির মাধ্যমে উপজাতীয়দের যথাযথ অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। 'উপজাতি' হিসেবে শান্তি চুক্তিতে উপজাতীয়দের সংগঠন পিসিজেএসএস স্বাক্ষর করছে। তথাপিও উপজাতীয় নেতারা 'আদিবাসী' ইস্যুটি নিয়ে অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি করছে। সরকার এরইমধ্যে উপজাতীয়দের অধিকার বিষয়ক আইএলও-১০৭ অনুমোদন করেছে। যেখানে উপজাতীয় অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। তথাপি উপজাতীয় নেতারা নতুনভাবে আইএলও কনভেনশন-১৬৯ ও 'জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র (UN Declaration on the Rights of Indigenous Peoples ) - ২০০৭' অনুমোদন করার জন্য সরকারের উপর কৌশলে চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে।
সরকারের ভাষ্য মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা যদি তাদের আদিবাসী হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে তাহলে তারা তাদের তথাকথিত অধিকার বাস্তবায়নে জাতিসংঘের সহায়তা পাবে, এমনকি সরকারকে উক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে দায়বদ্ধ হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয়রা আইএলও-১৬৯ নিশ্চিত করতে পারলে পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্তৃত্বের ব্যাপারে সরকারের ভবিষ্যতে উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ থাকবে। এটি দেশের অখণ্ডতার উপর হুমকি স্বরূপ। 'আইএলও কনভেনশন-১৬৯' ও 'জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র-২০০৭' এ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের 'আদিবাসী' নাগরিকদের নিজস্ব এলাকা/অঞ্চলে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, ভূমি ও ভূখণ্ডের উপর অধিকার, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভূমি ও ভূখণ্ডের উপর সামরিক কার্যক্রম বন্ধের অধিকারসহ বেশ কিছু স্পর্শকাতর অধিকারের কথা বলা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশে বসবাসরত উপজাতি/ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়কে 'আদিবাসী' স্বীকৃতি প্রদান করা হলে দেশের মধ্যে 'আদিবাসী' দেশ অথবা ন্যূনতম স্বায়ত্তশাসন অর্জনের পথ সুগম হবে। উক্ত হীন উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষেই মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় নেতারা ও স্বার্থান্বেষী মহল 'আদিবাসী' মর্যাদা অর্জনের দাবিতে অপতৎপরতা চালাচ্ছে।
ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয়দের অবস্থান:
চট্টগ্রাম থেকে পার্বত্যাঞ্চলকে (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা) আলাদা করলে এই অঞ্চলের প্রমাণযোগ্য প্রাচীন ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেননা সুপ্রাচীন কাল থেকে উত্তরে ত্রিপুরা এবং দক্ষিণ-পূর্বে আরাকান রাজ্যের মধ্যবর্তী চট্টগ্রাম বন্দর-কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা জনপদসমূহে বাঙ্গালীদের প্রাধান্য থাকলেও সীমান্তবর্তী গভীর অরণ্য-বেষ্টিত অরক্ষিত অঞ্চলে পার্শ্ববর্তী এলাকা- ত্রিপুরা, মিজোরাম, আরাকান ও বার্মা থেকে পাহাড়ী যাযাবর শ্রেণির কিছু গোত্র খাদ্যের সন্ধানে প্রায়ই প্রবেশ করত। আবার স্থান বদলের প্রক্রিয়ায় বেরিয়েও যেত। এদের মধ্যে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে কুকি জাতিগোষ্ঠীর পাংথুয়া, লুসাই ও উত্তর দিকের ত্রিপুরা অঞ্চল থেকে রিয়াং, উসুই ও ত্রিপুরাগণ উক্ত অঞ্চলে আসে। দক্ষিণ-পূর্ব দিকের বার্মা এবং আরাকান থেকে আসে ম্রো, চাক, খুমি, খোয়াং, বম, তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের লোকজন। তবে বর্তমানে যেসব উপজাতীয় জনগোষ্ঠী পার্বত্যাঞ্চলে বসবাস করছে তাদের কেউই সপ্তদশ শতকের পূর্বে এ এলাকায় এসেছে বলে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না।
অপরদিকে ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত 'রাজমালা' গ্রন্থসূত্রে জানা যায় যে, ত্রিপুরার মহারাজা রত্ন ফা ওরফে রত্নমাণিক্য (১২৭৯-১২৯০ খ্রিস্টাব্দ) এর আমলে পার্বত্যঞ্চলে বাঙ্গালিদের অস্তিত্ব ছিল। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন পার্বত্য জেলা তথা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় মোট জনসংখ্যা ১৮ লাখ ৪২ হজার ৮১৫ জন। এর মধ্যে বাঙালি ৯ লাখ ২২ হাজার ৫৯৮ (৫০.০৬%) জন এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতি ৯ লাখ ২০ হাজার ২১৭ (৪৯.৯৪%) জন।
এর মধ্যে চাকমা জাতি ষোড়শ শতাব্দী থেকে অদ্যাবধি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছে। চাকমা উপজাতি মূলত আরাকান রাজ্যের দৈংনাক সম্প্রদায়ের অংশ। তারা উক্ত সময়ে রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে পালিয়ে এসেছে।
একইভাবে মারমা উপজাতি ১৭৮৮ সালে আরাকান রাজ্যে বর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে এ অঞ্চলে পালিয়ে এসে বসতি গড়ে তুলেছে। উপরোক্ত ব্যাখ্যায় আদিবাসী ও উপজাতীয়দের মধ্যে কিছুটা মিল লক্ষ করা গেলেও এক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের আদিবাসী হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কারণ আদিবাসী হওয়ার প্রধান শর্ত হলো, কোনো দেশের সর্বপ্রাচীন বা আদিম বাসিন্দা হওয়া।
বিভিন্ন উপজাতীয় এবং অউপজাতীয় লেখকদের রচনাবলীতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পরিচয়:
নৃ-তাত্ত্বিক এবং জাতিতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে একথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী কোনো জনগোষ্ঠীই এখানকার মূল আদিবাসী (Aborigine) বা ভূমিপুত্রের (Son of the Soil) দাবিদার হতে পারে না। এখানকার বাঙালিরা যেমন সমতা থেকে আগমন করেছে তেমনি উপজাতিরাও ত্রিপুরা, আরাকান প্রভৃতি স্থান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসিত (Migrated) হয়েছে। কারো ইতিহাস প্রাচীন, আর কারো ইতিহাস আধুনিক।
প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ এবং বৃটিশ প্রশাসক Captain.H এর মতে "A great portion of the hill tribes, at present living in the Chittagong Hills, undoubt edly came about two generations ago from Arakan. This is asserted both by their own traditions and by records in the Chittagong Collectorate" (Lewin, 1869;p-28)।
চাকমারা বার্মার এ ঐতিহাসিক দলিল ছাড়াও সাম্প্রতিককালের উপজাতীয় (চাকমা) লেখকদের লেখা হতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন গবেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে চাকমা লেখক সুপ্রিয় তালুকদার তার চাকমা সংস্কৃতির আদিরুপ গ্রন্থে বলেছেন, 'চাকমাদের আদিনিবাস নির্ণয় করিতে হইলে পার্শ্ববর্তী বার্মা, শ্যাম প্রভৃতি দেশের এবং জাতির প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে জানিবার প্রয়োজনীয়তা রহিয়াছে বলিয়া মনে করি' (সূত্রঃ সুপ্রীয় তালুকদার, 'চাকমা সংস্কৃতির আদিরুপ', পৃষ্ঠা-৮)।
'চাকমাসহ অন্যান্য উপজাতীয়দের কেউই বাংলাদেশের তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিজ সন্তান নয়'- বিরাজ মোহন দেওয়ান (চাকমা সম্প্রদায় ভুক্ত) 'চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত' শীর্ষক গ্রন্থে উপসংহারে মন্তব্য করেছেন, 'চাকমাদের পূর্ব-পুরুষেরা যে পার্বত্য চট্রগ্রামের ভূমিজ সন্তান নহে তাহা স্পষ্ট'। বিরাজ মোহনের বক্তব্য 'পার্বত্য চট্রগ্রামের বিভিন্ন উপজাতি ও চাকমাদের সম্পর্কে যে সব উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ পাওয়া গিয়াছে তাহাতে চাকমাগন কোথা হইতে আসিয়াছেন এবং তাহাদের আদি উৎপত্তিই বা কোথায়, বহুগ্রন্থকার ঐ বিষয়ে আলোকপাত করিয়াছেন। কিন্তু এই জাতির (চাকমা) সঠিক পরিচয় নির্ণয়ে কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া তাহাদের পক্ষে সম্ভব হয় নাই'।
চাকমা বুদ্ধিজীবিদের মতে, তারা কখনো হিমালয়ের পাদদেশে, কখনো আসামে, কখনো ত্রিপুরায়, কখনো সিলেটে, কখনো বার্মায় বসবাস করেছিল। এর মানে এই হলো যে, চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নয় বরং বহিরাগত ও আশ্রিত।
একটি জাতি বা গোষ্ঠী জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোন নামে পরিচিতি লাভ করবে তা নির্ধারণ করা হয় ওই জাতির ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের উপর। কোনো জাতি হতে পারে বঞ্চিত, দারিদ্র, পশ্চাৎপদ, অনুন্নত কিংবা অনগ্রসর। কিন্তু এগুলোর উপর ভিত্তি করে কোনো একটি জাতি বা গোষ্ঠীকে বিশেষ নামে ভূষিত করা যায় না।
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: