• NEWS PORTAL

  • বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

সেপ্টেম্বরে রূপপুরে আসবে ইউরেনিয়াম, অক্টোবরে হস্তান্তর; ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হবেন পুতিন

রিশান নাসরুল্লাহ, বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১১:২২, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আপডেট: ১১:৪৬, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ফন্ট সাইজ
সেপ্টেম্বরে রূপপুরে আসবে ইউরেনিয়াম, অক্টোবরে হস্তান্তর; ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হবেন পুতিন

পাবনার রূপপুরে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত জ্বালানি (ইউরেনিয়াম) চলতি মাসের ২৮ তারিখের মধ্যে রাশিয়া থেকে দেশে এসে পৌঁছাবে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে জ্বালানি রূপপুর কর্তৃপক্ষের হস্তান্তর করবে রাশিয়া।

জ্বালানি দেশে আনা ও হস্তান্তর নিয়ে সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় একটি প্রস্তুতি সভা হয়েছে। সভায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আলী হোসেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক ড. শৌকত আকবর, রোসাটম ও রাশিয়ার প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জ্বালানি হস্তান্তর অনুষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সোমবারের সভায় আলোচনা হয়েছে। সভায় বিষয়বস্তু ও সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হবে। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সংক্রান্ত সবকিছু চুড়ান্ত করবেন।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনলাইনে ভার্চ্যুয়ালি অংশ নেবেন। এছাড়া ভার্চ্যুয়ালি উপস্থিত থাকতে পারেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও। বিষয়টি নিয়ে দু’দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-এর মহাপরিচালক রাফায়েল মারিয়ানো গ্রসিও এবং রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভও উপস্থিত থাকবেন।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান জানিয়েছেন, সবকিছু ঠিক থাকলে ৫ অক্টোবর ইউরোনিয়াম হস্তান্তর হবে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দীর্ঘ চেষ্টায় প্রকল্পটি চূড়ান্ত বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছে। এটা দেশের জন্য বিরাট অর্জন মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী থাকবেন।  ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লিদিমির পুতিনের যুক্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।  

এ বিষয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর জানিয়েছেন, প্রকল্পের কিছু বিষয়ে রাশিয়ানদের অনুমোদনের দরকার রয়েছে। সেসব অনুমোদন পেলেই ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের অনুষ্ঠানটি হবে। তিনি বলেন, যে কোনো দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প এলাকায় জ্বালানি (ইউরেনিয়াম) পৌঁছালে তখন দেশটি আন্তর্জাতিক নিউক্লিয়ার ক্লাবে অন্তর্ভুক্ত হয়। সে হিসেবে অক্টোবরে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নিউক্লিয়ার ক্লাবের সদস্য হিসেবে বিবেচিত হবে। ড. শৌকত আকবর বলেন, মর্যাদা পাওয়ার পাশাপাশি বিশ্বের  দরবারে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবেও পরিচিতি লাভ করবে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে উৎপাদন শুরু করতে আর কোনো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জও থাকবে না।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কড়া নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত পারমাণবিক জ্বালানি বিশেষ বিমানে শাহজালার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছানোর পর তা সড়ক পথে নেয়া হবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রথম ইউনিটের প্রথম ব্যাচের জ্বালানি রূপপুরে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। এরপর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে জ্বালানি বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে রাশিয়া।

সূত্র মতে, রাশিয়া থেকে বিশেষ বিমানে সাতটি চালানের মাধ্যমে দেশে আনা হবে পারমাণবিক জ্বালানি। যা দিয়ে এক বছরের বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এরপর ধাপে ধাপে আসতে থাকবে পারমাণবিক জ্বালানি। চুক্তি অনুযায়ী প্রথম তিন বছর বিনামূল্যে বাংলাদেশকে জ্বালানি সরবরাহ করবে রাশিয়া। প্রথম তিন বছর প্রতি ১২ মাস অন্তর প্রায় এক তৃতীয়াংশ জ্বালানি পরিবর্তন করে নতুন জ্বালানি লোড করা হবে। এরপর ১৮ মাস পর পর জ্বালানি পরিবর্তন করা হবে। পর্যায়ক্রমে এ সাইকেল আরো দীর্ঘ হবে।

এরইমধ্যে গত ৮ আগষ্ট ডামি ফুয়েল (ইউরেনিয়ামের আদলে তৈরি নকল পারমানবিক জ্বালানি দন্ড) দিয়ে পরিবহন, স্থানান্তর ও সংরক্ষণের কাজের মহড়া শেষ হয়েছে। ইউরেনিয়াম পরিবহন ও সংরক্ষণে যাতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয়, সেজন্যই আইন অনুযায়ী চূড়ান্ত প্রক্রিয়ার আগে ডামি ফুয়েল দিয়ে এ মহড়া দেয়া হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, খুবই স্পর্শকাতর এ জ্বালানি আমদানি, পরিবহন ও সংরক্ষণের জন্য আইএইএর অনুমোদন ও লাইসেন্সের পাশাপাশি রাশিয়ার রপ্তানি নীতির আলোকে অনুমতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তারা জানান, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে স্পর্শকাতর এ জ্বালানি পরিবহনে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। এ সময় সেনাবাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, দমকল বাহিনী, পরমাণু শক্তি কমিশন, স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়, রাশিয়ার প্রতিনিধিদলসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।

জ্বালানি পরিবহন প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ও আন্তর্জাতিক পরমাণু বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ শৌকত আকবর বলেন, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) নির্দেশনা মেনেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি আমদানি, পরিবহন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। বিশ্বে কোথাও পারমাণবিক জ্বালানি পরিবহনের সময় দুর্ঘটনার রেকর্ড নেই। সুতরাং এ নিয়ে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

ড. শৌকত আকবর জানান, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কমিশনিং কাজ শেষে উৎপাদন শুরুর পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগিয়ে চলছে। তিনি জানান, আইএইএর সব ধরনের নিয়মকানুন মেনে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।

বাংলাদেশ এটমিক এনার্জি রেগুলেটরি এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পারমাণবিক জ্বালানি পরিবহনের ক্ষেত্রে বীমা অথবা আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা আছে। যেহেতু পারমাণবিক জ্বালানি পরিবহনে ঝুঁকি নেই, তাই বীমার পরিবর্তে আর্থিক নিরাপত্তার অপশনটি বেছে নিয়েছে বাংলাদেশ।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য অনুযাযী, প্রাথমিক পর্যায়েই জ্বালানি পরিবহনে বীমা করা হলে প্রতি বছর কিস্তি বাবদ যে অর্থ ব্যয় হবে তাতে বিদ্যুতের দামও বেড়ে যাবে। এছাড়া প্রমিয়ামের বড় খরচ তো রয়েছেই। তাই আর্থিক ও ঝুঁকির সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আর্থিক নিশ্চয়তাপত্র ইস্যু করেছে সরকার।

আর্থিক নিরাপত্তা গ্যারান্টি প্রসঙ্গে নিউক্লিয়ার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, ফ্রেশ পারমাণবিক ফুয়েল দন্ডে সুরক্ষা স্তর থাকে। ফলে স্বাভাবিক অবস্থায় সেখান থেকে রেডিয়েশন (বিকিরন) ছড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। বিশেষ উপায়ে পরিবহনের পাশাপাশি বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী ও বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। তাই পরিবহনের মতো স্বল্প সময়ের জন্য সামান্য এ আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কায় বীমা করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় না করাটাই সঠিক সিদ্ধান্ত।

আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুযায়ী, বিভিন্ন ধাপে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের কাজ শেষ করে সেটি চূড়ান্ত উৎপাদন পর্যায়ে পৌছায়। সে অনুযায়ী রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মূল কমিশনিং পর্যায়ের কাজের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। কমিশনিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক চুল্লিতে নিরাপদে পারমাণবিক জ্বালানি লোড করা, সুষ্ঠভাবে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের ‘ফিজিক্যাল স্টার্টআপ’ কার্যক্রম সম্পন্ন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে গ্রিড লাইন সিনক্রোনাইজেন বা যুক্ত করা, পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সবশেষে বাণিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করা।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ভিভিইআর ১২০০ মডেলের। কেন্দ্রটির দুটি ইউনিটে মোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এর মধ্যে ১২০০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিটটি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় ইউনিটটি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসতে পারে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ৪০০ কেভি ও ২৩০ কেভির বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটির কাজ পেয়েছিল জার্মানির সিমেন্স এজি। বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণের কাজের শেষের দিকে হঠাৎ করেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়। এরফলে রাশিয়ার ওপর যে অর্থনৈতিক অবরোধ দেয়া হয় তাতে কিছুটা ধীরগতিতে কাজ চলে। এছাড়া ভারতীয় ঋণে গ্রিড লাইন নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হলেও ঋণে অর্থ ছাড়ে বিলম্ব হওয়ায়ও গ্রিড লাইন নির্মাণ কাজ অনেক পিছিয়ে পড়ে। এখনো প্রকল্পটির অগ্রগতির সঙ্গে গ্রিড লাইন নির্মাণ এগুতে পারছে না। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রিড লাইন নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা যাবে না।

গ্রিড লাইন নির্মাণের অগ্রগতি সর্ম্পকে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর বলেন, রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গ্রিড লাইন, সাবস্টেশন নির্মাণ এগুতে পারেনি। তবে এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিষয়টি তদারকি করা হচ্ছে। আশা করছি গ্রিড লাইনের কাজ যথাসময়েই শেষ হবে। তিনি বলেন গ্রিড লাইন নির্মাণ সম্পূর্ন না হলে আইন অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা যাবে না।

প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (রোসাটম) রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাস্তবায়নে কাজ করছে। আর্থিক অংকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পের ৯০ ভাগ ঋণ সহায়তা হিসেবে দিচ্ছে রাশিয়া। দুটি ইউনিট বিশিষ্ট রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন এবং দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৫ সালের আসার কথা থাকলেও ২০২৬ সালে উৎপাদনে আসতে পারে।

বিভি/এইচএস

মন্তব্য করুন: