কমলা হ্যারিস-ডগ এমাহফ: এক অত্যাশ্চর্য প্রেমকাহিনী
সুমন ভট্টাচার্য
মধুবালা, সে আলা দিখতি হো... মেরি নজরসে তুমকো দেঁখু তো... বলিউডের জনপ্রিয় সুরকার অমিত দ্বিবেদীর গানটি শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিলো, ডগলাস এমাহফ বা কমলা হ্যারিস কি গানটা শুনেছেন? এমনিতে নিজের ভারতীয় আইডেন্টিটি’র কথা বলতে অভ্যস্ত কমলা হ্যারিস হয়তো ভারতীয় সুরকারের জনপ্রিয় গানটি শুনে থাকতে পারেন। আসলে একটি বড় শহরে ভাগ্য অন্বেষণে আসা একজন পুরুষ এবং নারীর একে অপরকে ভালো লাগার, হৃদয় দেওয়ার যে গল্প মধুবালা গানটি বলে, তার সংগে তো অদ্ভুত মিল রয়েছে। বাস্তবতা হলো, কমলা হ্যারিস এবং ডগলাস এমাহফের প্রেম, পরিণয় ও সম্পর্ক নিয়ে বিশ্ববাসীর তেমন মাথাব্যথা ছিলো না ক’দিন আগেও। কিন্তু গত বুধবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে (মূলতঃ নবেম্বরের নির্বাচনের পর থেকেই) কমলা হ্যারিস যখন শপথ নিলেন, প্রথম মহিলা, প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিবাসী হিসেবে, তখন শুধু অভিবাসীদের জন্যই নতুন ইতিহাস তৈরি হয়নি, ইহুদি ডগলাস এমাহফের সংগে তাঁর বিয়ে, সম্পর্কও আমেরিকার পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতিকে নতুন করে আখ্যায়িত হলো। নিউইয়র্ক টাইমসের মতো বিখ্যাত সংবাদপত্রও সম্ভবত সেই কারণেই আমেরিকার প্রথম মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত জীবন এবং পরিবার নিয়ে এতো প্রতিবেদন ছাপলো।
নবনির্বাচিত মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস, সঙ্গে স্বামী ডগ এমাহফ
কমলা হ্যারিসের শপথ, মার্কিন রাজনীতিতে তাঁর সাফল্য একজন অভিবাসীকে ঠিক কতোটা স্বপ্ন দেখাতে পারে, সেই বার্তা দেয়। ২০০৮-এ বারাক ওবামার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন হিসেবে প্রেসিডেন্ট হওয়া যদি কালো চামড়ার মানুষদের, অভিবাসী পুরুষদের জন্য মাইলফলক হয়, তাহলে ২০২১-এর ২০ জানুয়ারি অভিবাসী মহিলাদের জন্য ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। নবেম্বরে নির্বাচনে জেতার পর জো বাইডেনের পাশে দাঁড়িয়ে কমলা হ্যারিস যে মহিলাদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, যাদের গায়ের রং সাদা নয়। মার্কিন রাজনীতিতে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যে মহিলারা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে ট্রাম্প জমানার চার বছরের অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতি, অভিবাসী-বিরোধী নীতির পর একজন কালার্ড ওম্যান-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়া তো ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।কমলা হ্যারিস-জো বাইডেন
এটা বোধহয় ইতিহাসের আশ্চর্য সমাপতন যে, নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের প্রথম কয়েকটি ঘোষণার মধ্যেই অভিবাসন নীতি বদলের ইংগিত রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ কায়েম করতে চেয়ে যে কঠোর অভিবাসন নীতি তৈরি করেছিলেন, বাইডেন-কমলার ডেমোক্র্যাট প্রশাসন ইতিমধ্যেই তার উল্লেখযোগ্য বদলের শুভসূচনা করেছেন। এখন অনেকেই ভাবছেন, আমেরিকা আবার নিজের স্বপরিচয়, অর্থাৎ অভিবাসীদের দেশের তকমা ফিরে পেতে চলেছে। এটা যদি ২০২১-এর মার্কিন প্রশাসনের একটা চেহারা হয়, তাহলে কমলা হ্যারিসের শপথ আর কিসের প্রতীক? নিউইয়র্ক টাইমস চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছে, একজন কৃষ্ণাঙ্গ বা কালার্ড ওম্যান, যিনি স্বপ্ন দেখেছেন, ৪০ বছরে পৌঁছে প্রেমে পড়ে বিয়ে করার ঝুঁকি নিয়েছেন এবং নিজে মা না হয়েও দুই তরুণ-তরুণীর সৎ মা হওয়ার দায়িত্ব চমৎকারভাবে পালন করেছেন। কমলা হ্যারিস তাই রাজনৈতিক দিকের পাশাপাশি সামাজিক দিক থেকেও নতুন আইকন হয়ে উঠেছেন। আমেরিকা, যেখানে পরিবার এবং পারিবারিক মূল্যবোধ রাজনীতিতে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে, ভোটে সফল হওয়ার জন্য অন্যতম চাবিকাঠি হয়ে ওঠে, সেখানে কমলা হ্যারিস নতুন রোল মডেল। তাঁর এবং ডগলাস এমাহফের সম্পর্ক নিয়ে তাই এতো চর্চা,এতো আলোড়ন। কিন্তু কেন চর্চা? কেন আলোড়ন? আধুনিক ইতিহাসের আয়রন ওম্যান, প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার-এর পর এই প্রথম আরেকজন মহিলা ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে বসেছেন বলে? না ডেনমার্ক-এর সুপারহিট টেলিভিশন সিরিজ বোর্গেন দেখার পর থেকে পশ্চিমা দুনিয়া সবসময় চিন্তিত থাকে একজন ক্ষমতাশালী মহিলা রাজনীতিকের জীবনে পুরুষটি কেমন হবেন, তাই নিয়ে? বোধহয় এই সবকিছুর ককটেলে আচ্ছন্ন পৃথিবীর জন্য, আধুনিক নাগরিক সভ্যতায় নারী-পুরুষের ক্ষমতা, অধিকারের কাঠামোকে প্রতিস্পর্ধী চেহারা দেওয়ার জন্যও কমলা হ্যারিসের স্বামী, ডগ এমাহফ নতুন রোল মডেল। যিনি আগেও বলেছেন, স্ত্রীর সংগে ওয়াশিংটনে পা রাখার প্রাক-মূহুর্তেও বলেছেন, আমার একটাই কাজ, ওকে সমর্থন করে যাওয়া।নবনির্বাচিত মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস
ডগলাস এমাহফ বারবার এটা বলেন বলেই মনে হয়, তাঁর সংগে কমলা হ্যারিসের সম্পর্কটা এক অত্যাশ্চর্য প্রেমকাহিনী, আধুনিক রূপকথা। এক কালো মেয়ের সংগে সাদা ইহুদির প্রেমে ভেসে যাওয়ার গল্প। এক অভিবাসী তরুণীকে এক ডিভোর্সি পুরুষের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসার কাহিনী। মনে রাখতে হবে, ক্যালিফোর্নিয়ার আইনজীবী কমলা হ্যারিসের সংগে যখন ডগলাস এমাহফ-এর পরিচয় হয়েছে, তখনও তিনি সিনেটর হননি। কিন্তু বিবাহ বিচ্ছিন্ন আইনজীবী ডগলাস এমাহফ পেশার দিক থেকে দারুণ সফল। সেই সফল, উচ্চবিত্ত ইহুদি আইনজীবী প্রথম ডিনারে এসেই কমলা হ্যারিস-এর এমন প্রেমে পড়ে গেলেন যে, রাতে ফিরে মেইল করে জানিয়ে দিলেন, ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহিলার জন্য তিনি কোন্ কোন্ সন্ধ্যা বরাদ্দ রেখেছেন, এবং আবার ডিনার ডেট-এর জন্য তিনি কতোটা উন্মুখ। সেই শুরু। তারপর থেকেই ইহুদি ডগলাস এমাহফ প্রতিটি মিনিটে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিসের স্বপ্ন দেখার শরিক হয়ে থেকেছেন। সিনেটর হওয়ার সাফল্য, এরপর ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার দৌড় থেকে ছিটকে যাওয়ার ব্যর্থতা পর্যন্ত, জীবনের প্রতিটি চড়াই-উৎরাইতে। এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার, স্বপ্ন ছোঁয়ার লড়াইতেও। এই যে বিপরীত মেরু থেকে আসা এক নারী ও পুরুষের পরষ্পরের প্রতি ভালবাসা, সহমর্মিতা এবং একের অপরকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা, এটাই তো অমিত দ্বিবেদীর মধুবালা গানের উপজীব্য। এই কারণেই তো কমলা হ্যারিস এবং ডগলাস এমহাফ-এর সম্পর্ক নিয়ে এতো চর্চা, এতো উচ্ছ্বাস। বুধবার ডগলাস এমাহফকে সংগে নিয়ে কমলা হ্যারিস-এর হোয়াইট হাউসে ঢুকে পড়া যদি একটি আধুনিক রূপকথা হয়, তাহলে আগামীতে কী অপেক্ষা করে আছে? সেটাও আমেরিকার প্রথম মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট বলে দিয়েছেন। কমলা হ্যারিস-এর কথায়, আমিই প্রথম, কিন্তু শেষ নই।
মন্তব্য করুন: