মঞ্চের যুবরাজকে মনে আছে? পুরো নাম খালেদ মাহমুদ খান যুবরাজ। হ্যাঁ, বলছি সেই জনপ্রিয় অভিনেতা খালেদ খানের কথা। ১৯৭৮ সালে নাগরিক নাট্যদলের 'দেওয়ান গাজীর কিসসা' নাটকে কাজ করার মাধ্যমে তার অভিনয় জীবনের শুরু। তিনি ৩০টিরও বেশি নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি নির্দেশনা দিয়েছেন ১০টি নাটকে।
মনে পড়ে সেই সংলাপ- "ছি, ছি, তুমি এতো খারাপ।" হ্যাঁ ইমদাদুল হক মিলনের সাড়া জাগানো সেই নাটক রূপনগর (১৯৯৪ সালে বিটিভি'তে প্রচারিত)। যেখানে খল চরিত্রে অভিনয় করেও দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন যুবরাজ, খালেদ খান। শুধু রূপনগরের ‘হেলাল’ই নয়, এর পুরো বিপরীত চরিত্র এইসব দিনরাত্রির ‘যাদুকর আনিস’ এর কথাও দর্শকদের কাছে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। ইমদাদুল হক মিলনেরই আরেকটি সাড়া জাগানো ধারাবাহিক নাটক ‘কোন কাননের ফুল’ এ বুড্ডা চরিত্রটি ক্যারিয়ারের আরেকটি অন্যতম সেরা কাজ। বিটিভির ধারাবাহিক নাটকের ইতিহাসে পথিকৃৎ ‘সকাল সন্ধ্যা’তেও ছিলেন বিশেষ চরিত্রে। প্রথম নাটক সিঁড়িঘর, হুমায়ূন আহমেদের ‘একা একা’য় প্রশংসিত হন।
বাংলা নাটকের ইতিহাসে থ্রিলার হিসেবে মোহাম্মদ হোসেন জেমীর লোকার শিকল ও দমন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, দুইটাতেই ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়। বর্নাঢ্য অভিনয় জীবনে আরো দেখা গেছে ফেরা, ওথেলো এবং ওথেলো, মফস্বল সংবাদ, শীতের পাখি, দক্ষিণের ঘর, মৃত্যু ও একটি প্রশ্নসহ অসংখ্য নাটকে।
সিনেমায় দেখা গেছে মাত্র দুইটি ছবিতে, পোকামাকড়ের ঘর বসতি ছিল প্রথম সিনেমা এবং অনেকদিন পর অভিনয় করেন আহা! তে।
১৯৫৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলাধীন মসদই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন খালেদ খান। আজকের দিনে বেঁচে থাকলে পেরোতেন ৬৩ বছর, বড় অকালেই চলে গেলেন এই প্রবাদপ্রতীম অভিনেতা।
খালেদ খানের বাবা নজরুল ইসলাম খান স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মা খালেদা বেগম গৃহিণী ও সংগীত অনুরাগী ছিলেন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে খালেদ খান সবার বড়। ভাইয়ের হার ধরে শাহীন খান অভিনয়ে এলেও পরে আর পেশাগত কারণে আর ধরে রাখতে পারেননি। খালেদ খানের ছোট ভাই মামুন জাহিদ বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য সঙ্গীত শিল্পী। স্ত্রী মিতা হক বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী।
খালেদ খানের অভিনয় জীবনের হাতেখড়ি মঞ্চে। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের ছাত্র। ১৯৭৫ সালে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে মঞ্চনাটকে তার যাত্রা শুরু হয়। মঞ্চে তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে: দেওয়ান গাজীর কিসসা, অচলায়তন, নূরলদীনের সারা জীবন, ঈর্ষা, দর্পণ, গ্যালিলিও ও রক্তকরবী। রক্তকরবীর ‘বিশু পাগলা’ করে তো আজীবন মঞ্চপ্রেমীদের কাছে প্রিয় হয়ে থাকবেন।
[caption id="attachment_70586" align="aligncenter" width="798"]

রক্তকরবী'তে খালেদ খান ও অপি করিম[/caption]
ঈর্ষা নাটকে অভিনয়ের জন্য কলকাতায়ও তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন। খালেদ খান নির্দেশিত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে: রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারা, পুতুল খেলা, কালসন্ধ্যা, স্বপ্নবাজ রূপবতী, মাস্টার বিল্ডার, ক্ষুদিত পাষাণ।
১৯৮১ সাল থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে টিভি নাটকে অভিষেক হয় তার। খালেদ খান অভিনীত প্রথম টিভি নাটক হলো সিঁড়িঘর।
খালেদ খান নিঃসন্দেহে এক শক্তিমান অভিনেতা, সব ধরনের চরিত্রেই মানিয়ে নেয়ার প্রতিভা ছিল, কন্ঠস্বর ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা, দারুণ আবৃত্তি করতেন, গাইতেনও দারুণ। তবে দুঃখের বিষয় নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি বেশ অচেনা। তিনি অদেখা ভূবনে চলে গেছেন ২০১৩ সালে, তারও অনেক বছর আগ পর্যন্ত টিভিতে অনিয়মিতই ছিলেন, তাই নতুন প্রজন্ম তার নাটক সেভাবে দেখেনি। সিনেমাও করেছেন খুব কম, অথচ সিনেমার একজন দুর্দান্ত অভিনেতা হতে পারতেন তিনি হউক সেটা খল থেকে নায়ক কিংবা বৈচিত্র্যময় চরিত্রে।
তবুও পাওয়া হয়নি একুশে পদক, বেঁচে থাকাকালীন সেইরকম কোন উল্লেখযোগ্য পুরস্কারই পাওয়া হয়নি এই বিশিষ্ট অভিনেতার। মরণোত্তর একুশে পদক আদৌ পাবেন কিনা সেটা কর্তৃপক্ষই জানেন।
শুভ জন্মদিন….. অভিনয়ের যুবরাজ, খালেদ খান।
মন্তব্য করুন: