মুজিব বন্দনার পরিবর্তে পাঠ্যবইয়ে ফিরেছে নব্বইয়ের গল্প-কবিতা
বিগত ১৭ বছরের শাসনামলে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির সবকিছুকেই শুধু শেখ মুজিব পরিবার কেন্দ্রিক করেছিল হাসিনা সরকার। দেশের সকল পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃত করে শুধু নিজের বাবা-ভাইয়ের গল্প তুলে ধরেছিলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু গেল জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার হাসিনার সরকার পতনের পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। পরিবর্তীত এই বাস্তবতায় ওই বিকৃত ইতিহাস সংশোধন করা হয়েছে নতুন বছরের পাঠ্যপুস্তক থেকেও।
২০২৫ সালে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির জন্য প্রকাশিত পাঠ্যবই পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ বছর বই থেকে সাতটি গদ্য-পদ্য বাদ দেওয়া হয়েছে। তার বিপরীতে যুক্ত করা হয়েছে নতুন আটটি গদ্য-পদ্য। সকল বই থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের একক গুণকীর্তন করে লেখা কবিতা-প্রবন্ধ সরিয়ে যুক্ত করা হয়েছে জাতীয় চার নেতার জীবনী, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস। তবে শেখ হাসিনার সময় এককভাবে শুধু শেখ মুজিবের অবদান তুলে ধরে তার গুণকীর্তন করা হলেও নতুন পাঠ্যপুস্তকে জিয়াউর রহমান, সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানীও রয়েছেন। চলুন দেখে নেওয়া যাক, কোন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে এসেছে কী পরিবর্তন?
প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ে আবারও যুক্ত হয়েছে পিঁপড়া ও পায়রার গল্পটি। ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়’ অধ্যায়ের নাম বদলে করা হয়েছে ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’। সেখানে শুরুতে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের একটি দৃশ্য। ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা উল্লেখ থাকলেও এখন তা বাদ দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর লেখা ‘সোনার ছেলের জায়গায় আবারও যুক্ত করা হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ওপর ‘দুখু মিয়ার জীবন’ ও ‘সিংহ আর ইঁদুরের গল্প’। নাম পরিবর্তন করে ‘পহেলা বৈশাখ’ গদ্যকে করা হয়েছে ‘নববর্ষ’। এই গদ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রার ছবির স্থানে যুক্ত করা হয়েছে নববর্ষের অন্য ছবি।
তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বই থেকে বাদ গেছে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা গদ্য ‘সেই সাহসী ছেলে’। বিপরীতে যুক্ত করা হয়েছে ‘ঘাসফড়িং ও পিঁপড়ার গল্প’ এবং ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেবেলা’।
একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে শুধু শেখ মুজিবকে নিয়ে লেখা ‘আমাদের জাতির পিতা’ গদ্যটি বাদ দেওয়া হয়েছে। সেখানে স্থান পেয়েছে শেখ মুজিবসহ জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে লেখা ‘আমাদের চার নেতা’। তৃতীয় শ্রেণীর ইংরেজি বইয়ের শেষ অধ্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ ছেলে শেখ রাসেলের জীবনী নিয়ে লেখা ‘অ্যা ওয়ান্ডারফুল বয়’ গদ্যটিও বাদ দেওয়া হয়েছে।
চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বইয়ে নেই শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে মমতাজউদ্দীনের লেখা ‘বাংলার খোকা’ এবং নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ‘মুজিব মানে মুক্তি’। এর পরিবর্তে যোগ করা হয়েছে ‘টুনুর কথা’ ও রজনীকান্ত সেনের কবিতা ‘স্বাধীনতার সুখ’। ‘মোবাইল ফোন’ নামক গদ্যটিও বাদ দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে ‘বই পড়তে অনেক মজা’ শিরোনামের অন্য একটি গদ্য।
একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে কোনো গদ্য-পদ্য বাদ বা যুক্ত করা না হলেও আনা হয়েছে ছোট ছোট ভাষাগত অনেক পরিবর্তন। তবে বইটির ১৫ নম্বর অধ্যায়ে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান অংশে ‘বঙ্গবন্ধু’র পরিবর্তে ‘মওলানা ভাসানী’র নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ৭৮ নম্বর পৃষ্ঠায় আগে যেখানে শুধু শেখ মুজিবের ছবি ছিল, এখন সেই ছবির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছবিও। একইসঙ্গে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে যুক্ত করা হয়েছে ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস। ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ শিরোনামের এই প্রবন্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ আবু সাঈদ ও মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর ছবি যুক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে সূচিতে তেমন কোনো সংযোজন-বিয়োজন নেই।
প্রতিটি শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের মলাটেই আনা হয়েছে পরিবর্তন। সবগুলো বইয়ের মলাট থেকে শেখ হাসিনার ছবি সরিয়ে যুক্ত করা হয়েছে দেশপ্রেম ও শিক্ষণীয় নানান বাণি। এক্ষেত্রে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের দেয়াল লিখনগুলো।
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: