এবারও বর্ণহীন 'বৈসাবি'
বাংলাদেশে তিন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব হচ্ছে "বৈসাবি"। বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু- এই তিন নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে বৈসাবি'র উৎপত্তি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী বরণ করে বাংলা নববর্ষকে। পুরনো বছরের কালিমা আর জীর্ণতাকে ধুয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় তারা।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা বর্ষবরণ উৎসব পালন করে বিভিন্ন নামে। কেউ বৈসু, কেউ সাংগ্রাই আবার কেউ বিজু। বর্ষবরণ উৎসবকে ত্রিপুরারা বৈসু, মারমা সম্প্রদায় সাংগ্রাই ও চাকমারা বিজু বলে অভিহিত করে। আর সবগুলোর সমন্বিত রূপই হচ্ছে 'বৈসাবি'। সাধারণত: বছরের শেষ দুইদিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি পালিত হয় বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়।
চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের 'বৈসাবি' উৎসব:
[media type="image" fid="132841" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]
* ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসবের নাম বৈসু:
আগেই বলেছি, ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসবের নাম বৈসু। এই উৎসবকে তারা তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে উদযাপন করে। একটানা তিনদিন উদযাপিত এই আয়োজনে থাকে পর্যায়ক্রমে- হারি বৈসু, বিসুমা বৈসু ও বিসিকাতাল বা আতাদাং বৈসু।
বৈসু উৎসবের প্রথম দিনেই হারি বৈসু। এই দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে তারা ঘরদোর লেপে-মুছে, বসতবাড়ি কাপড়-চোপড় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে। ত্রিপুরারা বিশেষ একপ্রকার গাছের পাতার রস আর হলুদের রস মিশিয়ে গোসল করে। ফুল দিয়ে ঘরবাড়ি সাজায়। গবাদিপশুদের গোসল করানো হয় এবং ফুল দিয়ে সাজানো হয়। শিশুরা বাড়ি বাড়ি ফুল বিতরণ করে। তরুণ-তরুণীরা প্রিয়জনকে ফুল উপহার দেয়। দেবতার নামে নদীতে বা ঝর্ণায় ফুল ছিটিয়ে খুমকামীং পূজা দেওয়া হয়। কেউ কেউ পুষ্পপূজা করে। এদিন মহিলারা বিন্নি চাউলের পিঠা ও চোলাই মদ তৈরি করে। পুরুষরা বাঁশ ও বেত শিল্পের প্রতিযোগিতা ও খেলাধুলায় মেতে উঠে। এদিন এরা দাং, গুদু, চুর, সুকুই, উদেং ও ওয়াকারাই খেলায় অংশগ্রহণ করে। জুম কৃষক পাড়ার মধ্যে হাঁস-মুরগির জন্য শস্যদানা ছিটিয়ে দেয়।
হারি বৈসু উৎসবের দিন থেকে এরা গরুয়া নৃত্য পরিবেশন শুরু করে। এ নৃত্য সাত দিন থেকে আটাশ দিন পর্যন্ত চলে। ঢোলের তালে তালে সারিবদ্ধভাবে লোকজন নাচে। নাচ শেষে গরয়া পূজার ব্যবস্থা করা হয়।
দ্বিতীয় দিনে বিসুমাতে ত্রিপুরারা নববর্ষকে স্বাগত জানায়; ধূপ, চন্দন ও প্রদীপ জ্বেলে পূজা দেয় ও উপাসনা করে। এদিন তারা নিরামিষ ভোজন করে। কোনো প্রাণি বধ করে না।সবাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাচন, সেমাই ও মিষ্টি খায় এবং বিভিন্ন ধরণের পিঠা খায়।
অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিনও ফুল দেওয়া হয় ও উপাসনা করা হয়। তারা বয়োজ্যেষ্ঠদের গোসল করিয়ে পায়ের কাছে পূজার নৈবেদ্য হিসেবে ফুল রাখে এবং প্রণাম করে। এ দিনে তারা সর্বক্ষণ ঘরের দরজা খোলা রাখে। এতে গৃহস্থের কল্যাণ হবে বলে মনে করা হয়।
[media type="image" fid="132842" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]
* মারমাদের নববর্ষ বরণে 'সাংগ্রাই' উৎসব:
সাংগ্রাই উৎসবের মধ্য দিয়ে মারমারা পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। তারা বৈশাখের প্রথম দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পালন করে বাংলা নববর্ষ। পাচন, পিঠা এবং নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজন করে মারমা জনগোষ্ঠী। সববয়সের নারীপুরুষ সম্মিলিতভাবে নাচ আর গানে মেতে উঠেন।
মারমা বৃদ্ধরা অষ্টশীল পালনের জন্য মন্দিরে যায়। এদিন বুদ্ধ মূর্তিকে চন্দন জলে স্নান করানোর পর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও স্নান করেন।
মারমা জনগোষ্ঠীর এ দিনের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে জলকেলি বা পানি খেলা। মারমা ভাষায় জল অনুষ্ঠানকে বলা হয় রিলংপোয়ে। বাড়ির আঙিনায় আগে থেকে পানি খেলার জন্য প্যান্ডেল তৈরি করা থাকে। মারমা যুবকরা বাদ্য আর গানের তালে তালে এসে উপস্থিত হয় অনুষ্ঠানস্থলে। সেখানে ফুলে ফুলে সজ্জিত প্যান্ডেলের ভিতরে পানি নিয়ে অপেক্ষায় থাকে মারমা তরুণীরা। পানিকে পবিত্রতার প্রতীক ধরে নিয়ে মারমা তরুণ-তরুণীরা পানি ছিটিয়ে নিজেদের শুদ্ধ করে নেয়।
চাকমাদের বর্ষবরণ উৎসব 'বিজু'
চাকমারা তিন ভাগে ভাগ করে বিজু উৎসব পালন করে। চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ফুল বিজু, ৩০ তারিখে মূল বিজু এবং বৈশাখের প্রথম দিনে গজ্যাপজ্যা বিজু নামে অনুষ্ঠান পালন করে।
ফুল বিজু- গভীর অরণ্য থেকে ফুল সংগ্রহ করে চারভাগে ভাগ করে একভাগ ফুল ও নিমপাতায় ঘরবাড়ি সাজায়, দ্বিতীয়ভাগ ফুল বৌদ্ধ বিহারে বুদ্ধের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে প্রার্থণা করে ও ভিক্ষুসংঘদের ধর্মোপদেশ শ্রবণ করে, তৃতীয়ভাগ ফুল নদী, খাল বা পুকুরের পাড়ে তৈরি পূজামন্ডপে রেখে প্রার্থনা করে এবং চতুর্থভাগ ফুল প্রিয়জনকে উপহার দেয় এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানায়।
মূল বিজু'র দিনে অসংখ্য কাঁচা তরকারি সংমিশ্রণে পাচন বা ঘণ্ট তৈরি করা হয়। এছাড়া, পায়েস ও নানা ধরণের পিঠা তৈরি করা হয় এবং মাছ-মাংস রান্না করা হয়। বিন্নি ধানের খই, নাড়ু, সেমাই ও পাহাড়ি মদও থাকে। এই দিনে চাকমারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে র্যালিতে যোগ দেয়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িঘর, উঠান ও গোশালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সবার মঙ্গল কামনা করা হয়। মন্দিরে মোম জ্বালিয়ে ফুল দিয়ে বুদ্ধের পূজা করা হয়।
গজ্যাপজ্যা অনুষ্ঠিত হয় নববর্ষের প্রথম দিনে। এদিন চাকমারা বিশ্রাম করে। তারা বড়দের স্নান করিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থণা করে। সন্ধ্যায় সবাই বৌদ্ধবিহারে গিয়ে ধর্ম অনুশীলনে রত হয়, ভিক্ষু সংঘের ধর্মোপদেশ শোনা এবং বিশেষভাবে প্রার্থনায় অংশ নেয়াই এ দিনের কাজ।
নানা রংয়ে বর্ণিলভাবে পাহাড়ে 'বৈসাবি'র মধ্য দিয়ে বরণ করা হয় নতুন বর্ষকে। কিন্তু মহামারী করোনার কারণে গত বছরও হয়নি বর্ণিল উৎসব। এবারও সংক্রমণের হার বেশি হওয়ায় ঘরোয়াভাবেই উদযাপন হচ্ছে বৈসাবি।
মন্তব্য করুন: