রাঙামাটিতে স্মরণকালের পাহাড় ধস ট্র্যাজেডির ৮ বছর আজ

এভাবেই বের করা হয় শতাধিক মরদেহ। ফাইল ছবি
রাঙামাটির ভয়াবহ পাহাড় ধসের মর্মান্তিক ঘটনার ৮ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৭ সালের আজকের এই দিনে (১৩ জুনের) রাতে টানা তিনদিনের ভারী বৃষ্টি আর বজ্রপাতে ঘটে যায় স্মরণকালের পাহাড় ধসের ঘটনা। বছর ঘুরে দিনটি ফিরে এলে রাঙামাটিবাসীর মনে দেখা দেয় আতঙ্কের সেই ভয়াল স্মৃতি। স্বজন হারানো মানুষেরা আজো কাঁদে এই স্মৃতি মনে করে।
ভারী বর্ষণ ও বজ্রপাতের ফলে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে একদিনেই প্রাণ হারিয়ে ছিলেন, সেনা সদস্যসহ নারী পুরুষ ও শিশুসহ ১২০ জন। এর মধ্যে শহরের মানিকছড়িতে একটি সেনা ক্যাম্পের নিচে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম প্রধান সড়কের উপর ধসে পড়া মাটি অপসারণ করতে গিয়ে পুনরায় পাহাড় ধসের মাটি চাপা পড়ে নিহত হন ওই ক্যাম্পের দুই কর্মকর্তাসহ ৫ সেনা সদস্য।
নিহত সেনা সদস্যরা হলেন- মেজর মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, ক্যাপ্টেন মো. তানভীর সালাম শান্ত, করপোরাল মোহাম্মদ আজিজুল হক, সৈনিক মো. শাহিন আলম, ও সৈনিক মো. আজিজুর রহমান।
জেলা প্রশাসনের হিসাবে রাঙ্গামাটি সদরে ৬৬ জন, জুরাছড়ি উপজেলায় ৬ জন, বিলাইছড়ি উপজেলায় ২জন, কাপ্তাই উপজেলায় ১৮ জন এবং কাউখালী উপজেলায় ২১ জন মিলে মোট ১১৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে শিশু-৩৩, মহিলা-৩২, পুরুষ ৪৮ জনের মরদেহ পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে অন্য যে কোনো পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালের ১৩ জুনের পাহাড় ধসের ঘটনা সব চেয়ে বেশী। সকল পাহাড় ধ্বসকে হারা মানায় ১৩ জুনের এই পাহাড় ধ্বস। রাঙামাটি ব্যাপক প্রাণহানীর সাথে ব্যাপক ভৌত অবকাঠামো ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পাহাড়ে ঘরবাড়ি আছে এমন পাহাড়ও যেমন ভেঙ্গেছে, তেমনি ঘরবাড়ি ছিলো না এমন অসংখ্য পাহাড়ও ভেঙ্গে পড়ে। আবার ঝোপ জঙ্গল গাছপালাতে ভরপুর এমন পাহাড়ও ভেঙ্গে পড়ে। এক কথায় সব রকম পাহাড়েই মাটি ধসে পড়ে। এটার ব্যাপ্তি, বিস্তৃতিও গভীরতা অনেক বেশী ছিলো।
টানা তিনদিনের প্রবল বর্ষণে পাহাড় ধসে রাঙামাটির এত লোকের প্রাণহানি, ঘরবাড়ি, সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুতের এতোবড় ক্ষতি হবে সেদিন কেউ ভাবতে পারেনি। সেই দিন মুহূর্তেই সব দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো পর্যটন শহর রাঙামাটি। সারা দেশের সাথে রাঙ্গামাটি শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেনাবাহিনী ও সড়ক ও জনপথ বিভাগের সহযোগিতায় ৯ দিন পর সারা দেশের সাথে রাঙামাটির সড়ক যোগাযোগ কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
১৩ জুন রাত থেকেই শুরু হয়েছিলো প্রচন্ড গগনবিদারী আওয়াজে বজ্রপাতসহ ভারি বৃষ্টি। ভয়ে আতংকে সেই রাত কাটাতে হয়েছিলো রাঙামাটির মানুষকে। ভোর হওয়ার পর শহরের ভেদভেদী, মোনতলা, রাঙ্গাপানি, শিমুলতলি, মুসলিম পাড়া ও লোকনাথ মন্দির এলাকা, সদর উপজেলার মগবান ও সাপছড়ি ইউনিয়নসহ ৫টি উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির খবর আসতে থাকে। আর কোনো দুর্যোগে রাঙামাটিতে এতো প্রাণহানী ঘটেনি।
পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের শালবন এলাকায় ১০০ মিটার রাস্তা ধসে গিয়ে একেবারে বিলীন হয়ে যায়। দেশের অন্যান্য স্থানের সাথে রাঙামাটি ৯দিন সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। বিভিন্ন আন্ত সড়কে ১৪৫টি স্থানে সড়কে ভাঙ্গন দেখা দেয়। পাহাড় ধ্বসের বিপর্যয়ে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক ছাড়াও রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি-বান্দরবান সড়ক, রাঙামাটি-বড়ইছড়ি ও রাঙামাটি-কাপ্তাই সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন হয়ে যায়।
এছাড়া রাঙামাটির বৈদ্যুতিক গ্রীড লাইনের পোল ও লাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে শহরের ৩ দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে। আর বিশুদ্ধ পানির জন্য শহরের হাহাকার পড়ে যায়।
সেনাবাহিনী, সড়ক বিভাগ ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীদের দ্রুত প্রচেষ্টায় তিন দিনের মাথায় বিদ্যুৎ ও ১০ দিনের মধ্যে রাঙামাটি-চট্টগ্রামে সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করা সম্ভব হয়। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় কাপ্তাই-রাঙামাটি নৌ-পথে লঞ্চ দিয়ে পানি, জ্বালানী তেল ও পণ্য পরিবহনসহ লোকজনের চলাচলের ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রশাসন।
গৃহ হারা হয়ে রাঙামাটির ১২টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২ হাজারের বেশী মানুষ আশ্রয় নেয়। সেনাবাহিনী আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে পানি ও খাবার সরবরাহ করে।
রাঙামাটির ভয়াল পাহাড় ধ্বসের ঘটনার ৮ বছর পার হলেও এখনো অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এতো মৃত্যুর মিছিল ও বিপুল পরিমানের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির পরও লোকজন আজো পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছেন। গেলো আট বছরে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপুর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের সংখ্যাও বেড়ে গেছে।
প্রতি বছরের ন্যায় বর্ষার শুরুতেই এবারো জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহরে ও উপজেলগুলোতে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষদের বৃষ্টির সময় নিরাপদে সরে যেতে ও আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য ব্যাপক প্রচারণা ও সচেতনতা চালিয়ে যাচ্ছেন। শহরের বেশকিছু স্থানে পাহাড়ের পাদদেশে আবারও অসংখ্য বাড়ি-ঘর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তবে পাহাড়ের নীচে বসবাসকারীরা এখনও কেউই সড়ে যাওয়ার সেই প্রস্তুতি নেয়নি। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার অনিহা প্রকাশ করছেন বার বার।
দিনটির কথা স্মরণ করে এবছরও গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণের পাহাড় ধসের আশংকা এবং রাঙামাটি জেলায় প্রাণহানি এড়াতে আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসক। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে। শহরের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন করেছেন রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্ল্যাহ। এসময় তিনি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় যারা পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছেন তাদের বৃষ্টির সময় নিরাপদে সরে যেতে ও আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। বৃষ্টি শুরু হওয়ার সাথে সাথে লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসে প্রায় ১ হাজারের কাছাকাছি লোকজনকে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্ল্যাহ বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় রাঙামাটি জেলায় পাহাড় ধসের ঘটনায় যাতে প্রাণহানি না ঘটে তার জন্য আগাম সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। আর এইসব ব্যাপারে প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে দুর্যোগ প্রস্তুতি সভাও করা হয়েছে। সেখানে সবার সম্মিলিতভাবে দূর্যোগ মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণের নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিটি এলাকায় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা রাখা হয়েছে।
২০১৭ সালের ১৩ জুনের পাহাড় ধস রাঙামাটির ভূ-পৃষ্টতলকে (সারফেস) নাড়িয়ে দিয়ে অত্যন্ত নাজুক করেছে যা গত ৫ বছরেও কাটিয়ে উঠা যায়নি। যে কারণে রাঙামাটির অনেক সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তা দোকানপাটসহ সবকিছু অনিরাপদ করে দেয়। রাঙামাটিতে দৃশ্য ও অদৃশ্য অনেক বেশি ক্ষতি করে দিয়ে যায় সেই স্মরণ কালের পাহাড় ধসের ঘটনা। যা রাঙামাটিবাসী কোনো দিন ভুলতে পারবে না এই স্মরণকালের ভয়াবহ এই স্মৃতি ও হারানো বেদনা। তাই বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ের নীচে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বাড়ি ঘর নির্মাণে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে পাহাড় ধসের প্রাণহানী রোধ করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: