এলডিসি উত্তরণের আগে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনার আহ্বান লুৎফে সিদ্দিকীর

ফাইল ছবি
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক বিষয় সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেছেন, স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা (এলডিসি) থেকে উত্তরণ অনিবার্য হওয়ায় বাংলাদেশের উচিত গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) কিংবা অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি নিয়ে আলোচনা করা, যাতে তাদের বাজারে বিনা বাধায় প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে হবে, যাতে আমরা তাদের বাজারে অবাধ প্রবেশাধিকার পেতে পারি।
লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, চুক্তিতে শ্রমের মান, মানুষের চলাচল এবং মানবাধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত আছে।
মঙ্গলবার ব্যাংককে শ্রম ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সমস্যা সংক্রান্ত আইএলও এশিয়া-প্যাসিফিক সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপনকালে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত এসব কথা বলেন। আজ বুধবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
লুৎফে সিদ্দিকী বলেছেন, বাংলাদেশের নামমাত্র জিডিপির ভিত্তিতে বিশ্বে অবস্থান প্রায় ১৩৫তম এবং ভূমির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ৯৪তম। জনসংখ্যার দিক থেকে এটি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ।
নগররাষ্ট্র বাদ দিলে বাংলাদেশই বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ এবং জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ অষ্টম স্থানে রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ওই সাত দেশের মধ্যে মাত্র দু’টিতে আমাদের চেয়ে কম জনসংখ্যা রয়েছে। তাদের কোনো দেশই আমাদের মতো এত জনবহুল নয়।
মূল প্রবন্ধে লুৎফে সিদ্দিকী উল্লেখ করেন, বিপুল সংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠী একই সঙ্গে ডিজিটালি সংযুক্ত হলেও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের অভাব রয়েছে। এক বছর আগে তারা নাটকীয় এক আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের জন্য সংস্কার ও সুশাসনের নতুন যাত্রার সূচনা করেছিল। এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত বলেন, এলডিসি মর্যাদার ফলে বাংলাদেশ রপ্তানি খাতে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পেয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বৈশ্বিকীকরণের যুগে এ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি পোশাক শিল্প (আরএমজি) গড়ে উঠেছে, যা বাংলাদেশের মোট রপ্তানির বেশিরভাগ জুড়ে রয়েছে।
পাশাপাশি দেশে ওষুধ খাতে পেটেন্ট ফি ছাড়াই জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক অর্থায়নও তুলনামূলক সস্তায় এসেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানির সিংহভাগই তৈরি পোশাক শিল্প থেকে আসে, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সাথে সম্পর্কিত অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকারের ওপর নির্ভর করে।
আমাদের স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থাকায় অর্থ প্রদান ছাড়াই জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনের সুযোগ পাওয়া গেছে, যার ফলে কার্যত সমস্ত অভ্যন্তরীণ সরবরাহ এবং কিছু পরিমিত রপ্তানি সম্ভব হয়েছে।
স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা আমাদের বাণিজ্যিকভাবে যা পাওয়া যায় তার চেয়ে সস্তায় আন্তর্জাতিক অর্থায়ন পাওয়ার সুযোগ করে দেয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সুযোগ-সুবিধার ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতি নির্ভরশীল, সম্ভবত অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। ফলে এলডিসি সুবিধার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সেই অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করা একটি অন্যরকম জটিল চ্যালেঞ্জ হবে।
স্নাতক ডিগ্রি অর্জন অনিবার্য তা স্বীকার করে তিনি বলেন, কয়েক বছর বিলম্ব হলেও এটি তাদের কাজের ক্ষেত্র পরিবর্তন করে না।
সিদ্দিকী বলেন, বাস্তবে গত কয়েক মাসে ত্রাণ ও শুল্কের পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা থেকে এটা স্পষ্ট যে একতরফা, অ-পারস্পরিক, নিঃশর্ত অনুগ্রহের পরিমাণ অনেক কম।
তিনি বলেন, কেউ আমাদের বলবে না যে, দয়া করে এই সুযোগগুলো উপভোগ করুন, আমাদের বাজারে প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখুন, আপনার নিজস্ব বাজার রক্ষা করুন এবং শ্রম, পরিবেশগত বা ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টির ব্যাপারে যা ইচ্ছা তাই করুন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে ভালো যা করা সম্ভব তা হলো, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে হঠাৎ করেই সবকিছু পরিবর্তন না ঘটিয়ে মসৃণ উপায়ে পরিবর্তন নিশ্চিত করা।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত জানান, জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম প্রধান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (এফটিএ) কিংবা ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (ইপিএ) চূড়ান্ত করার উদ্যোগ চলছে এবং একই সঙ্গে জাপানে ১ লাখ দক্ষ কর্মী পাঠানোর একটি কাঠামোবদ্ধ প্রক্রিয়াও গড়ে তোলা হচ্ছে।
লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, বাংলাদেশকে রপ্তানি বাজারে বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে হলে শ্রমমান উন্নত করার অঙ্গীকার রাখতে হবে।
একইসঙ্গে শ্রম সংস্কার শুধু নৈতিক দায় নয় বরং বাজারে প্রবেশাধিকার বজায় রাখার জন্যও জরুরি।
তিনি আরও বলেন, নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার মর্যাদা ও শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রথমবারের মতো জাতীয় পর্যায়ে শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, যা সংবিধান, সংসদ ও বিচার বিভাগীয় সংস্কারের মতোই সমন্বিত ও ঐকমত্যভিত্তিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা এটি বাস্তবায়ন এবং বাস্তবায়নের সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে চিন্তিত। তবে স্পষ্ট করে বলা যায়, এলডিসি-পরবর্তী অনুকূল শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা করা সহজ হবে না; কারণ আমাদের আইএলও গভর্নিং বোর্ডে ২৬ নম্বর ধারার একটি অভিযোগ ঝুলছে।
শেষে লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, আইএলও’র সঙ্গে করা রোডম্যাপ অনুযায়ী বাংলাদেশ বেশিরভাগ অঙ্গীকার পূরণের পথে রয়েছে। আমরা তিনটি আরু অধিকার, সম্পর্ক ও স্থিতিস্থাপকতা নীতিকে সামনে রেখে কাজ করছি।
বিভি/এসজি
মন্তব্য করুন: