• NEWS PORTAL

  • রবিবার, ২৫ মে ২০২৫

Drama: Jamai Bou Chor
Drama: Jamai Bou Chor

উত্তরা গণভবন; অবারিত নান্দনিকতার হাতছানি

প্রকাশিত: ১৬:২৯, ৫ মার্চ ২০২১

আপডেট: ১৮:১০, ৫ মার্চ ২০২১

ফন্ট সাইজ
উত্তরা গণভবন; অবারিত নান্দনিকতার হাতছানি

নাটোর থেকে কামরুল হাসানের  বিশেষ রিপোর্ট।

নাটোর শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে এক মনোরম পরিবেশে ইতিহাস খ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী অবস্থিত। নাটোরের রাণী ভবানী তাঁর নায়েব দয়ারামের উপর সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে দিঘাপতিয়া পরগণা উপহার দেন। প্রাসাদের মতোই নাটোরের রাজবাড়িতে রয়েছে দীর্ঘ প্রবেশ পথ যার দু'ধারে বোতল পামের সুবিন্যাস লক্ষ্যণীয়। প্রায় তিনশত বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক ঐতিহ্যবাহী দিঘাপতিয়া রাজবাড়িটি নাটোরের উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত।

উত্তরা গণভবন

বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম উত্তরা গণভবন। নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দয়ারাম রায়। তিনি নাটোরের রাজা-মহারাজ রামজীবনের একান্ত অনুগত একজন দেওয়ান ছিলেন। বাংলার রাজা-জমিদারদের মধ্যে দিঘাপতিয়া রাজবংশ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে।

১৬৮০ সালে নাটোরের প্রখ্যাত কলম গ্রামের এক তিলি পরিবারে দয়ারাম রায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম নরসিংহ রায়। নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণের অধীনে চাকরি করতেন, সে সময়ে তিনি কাজের সুবাদে চলনবিল এলাকার কলম গ্রামে যান। রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণ ঠাকুরের অধীনে সাধারণ একজন কর্মচারী তখন দয়ারাম তাঁর মাসিক ৮ আনা বেতনে চাকরি করতেন। পরে সামান্য লেখাপড়া করে জমা খরচ রাখার মত যোগ্যতা অর্জন করেন এবং রামজীবন তাকে মাসিক ৮ আনার পরিবর্তে ৫ টাকা বেতনের মহুরী নিযুক্ত করেন। রাজা দর্পনারায়ণের স্নেহ, ভালবাসা ও সহানুভুতি, নবাব সরকারের ভ্রাতা রঘুনন্দনের প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং বাংলার নবাব দেওয়ান মুর্শিদকুলী খানের নেক-নজর ইত্যাদি সবকিছু মিলে যখন রামজীবন জমিদারী লাভ করেন তখন তারও ভাগ্য খুলতে থাকে। রাজা রামজীবন তাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন এবং প্রচুর অর্থ-সম্পদ তার কাছে গচ্ছিত রাখতেন। রাজা সীতারাম রায়ের পতনের পর দয়ারাম রায় নাটোর রাজ্যের একজন পরাক্রমশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।

নাটোর রাজ্যের উত্থানে দয়ারাম রায় অসামান্য ভূমিকা রাখায় ১৭০৬ সালের দিকে রাজা রামজীবন উপহার হিসেবে বাসস্থানের জন্য তাকে দিঘাপতিয়ায় কিছু জমি দান করেন। পরে জমিদার ও রাজা হওয়ার পর ১৭৩৪ সালে দয়ারাম রায় দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।

[caption id="attachment_76440" align="aligncenter" width="535"]রাজা দয়ারাম রায়ের ভাস্কর্য[/caption]

প্রাসাদের মূল অংশ এবং সংলগ্ন কিছু ভবন নির্মাণ করেছিলেন রাজা দয়ারাম রায়। রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায়ের আমলে ১৮৯৭ সালের ১০ জুন নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে তিন দিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের এক অধিবেশন আয়োজন করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন। অধিবেশনের শেষ দিন ১২ জুন, প্রায় ১৮ মিনিটব্যাপী এক প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে রাজ প্রাসাদটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। পরে রাজা প্রমদানাথ রায় ১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছর সময় ধরে বিদেশি বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও চিত্রকর্ম শিল্পী আর দেশি মিস্ত্রিদের সহায়তায় সাড়ে ৪১ একর জমির উপর এই রাজবাড়িটি পুনঃনির্মাণ করেন।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর দিঘাপতিয়ার শেষ রাজা প্রতিভানাথ রায় দেশ ত্যাগ করেন। এসময় থেকে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। ১৯৬৫ সালে তখনকার পাকিস্তান সরকার রাজবাড়িটি অধিগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালের ২৪ জুলাই তৎকালীন গভর্নর হাউসে রূপান্তরিত হয়। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এটিকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এই ভবনের মূল প্রাসাদের ভিতর মন্ত্রিসভার বৈঠক আহ্বান করেন। সেই থেকে ভবনটি ‘উত্তরা গণভবনে'র প্রকৃত মর্যাদা লাভ করে।

উত্তরা গণভবনের প্রবেশ পথে একটি বিরাটাকৃতির পাথরের ঘড়ি রাজা দয়ারাম সেই সময় ইংল্যান্ড থেকে এনছিলেন। এক সময় এই ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি বহুদূর থেকে শোনা যেত। প্রাসাদের ভিতর বহু প্রাচীন ও দুর্লভ প্রজাতির গাছের সমাবেশ ও সমারোহ। ঢাকার জাতীয় স্মৃতিসৌধের শোভাবর্ধনকারী রোপণকৃত ফুল ব্রাউনিয়া ও ককেসিয়া এখানকারই। এছাড়া, অন্যান্য বৃক্ষের মধ্যে এখানে আছে রাজ-অশোক, সৌরভী, পারিজাত, হাপাবমালি, কর্প‚র, হরিতকী, যষ্টিমধু, মাধবী, তারাঝরা, মাইকাস, নীলমণিলতা, হৈমন্তীসহ বিভিন্ন দুর্লভ প্রজাতির ফলজ ও ঔষধি বৃক্ষ। প্রাসাদের মধ্যে পরিখা বা লেকের পাড়ে এসব বৃক্ষের মহাসমারোহ।

প্রবেশ পথের চারিদিকে প্রাসাদঘেরা পরিখা যা পুরো রাজ প্রাসাদকে ঘিরে রেখেছে। ভেতরে বিশাল মাঠ ও গোলাপ বাগান, একপাশে গণপূর্ত অফিস। দ্বিতল হলুদ ভবনটি কুমার প্যালেস নামে পরিচিত। নিচতলাটি টর্চারসেল হিসেবে ব্যবহৃত হত। একটি একতলা তহসিল অফিস আছে। সে সময়কার চারটি কামান রাখা আছে এখনও। কামানগুলোর স্থাপন কাল ছিল ১৭৯৯ সাল। বিশাল রাজ দরবার সংলগ্ন বাগানে জমিদার দয়ারামের একটি ভাস্কর্য তাঁর স্মৃতির প্রতীক। প্রাসাদের মধ্যে একটি মিলনায়তন ভবনসহ রয়েছে আরো দুইটি ভবন। গাড়ি পার্ক করার গ্যারেজ আলাদা। যাবতীয় স্থাপনা মাঝখানে। প্রাসাদের ভেতর রয়েছে বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসপত্র। ভবনের মধ্যে জাদুঘর, বহু দর্শনীয় স্মৃতিস্তম্ভ, ভাস্কর্য ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য বিদ্যমান।

ইতালীয় গার্ডেন উত্তরা গণভবনের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অংশ। গার্ডেনটির আসবাবপত্র ইতালি থেকে আনা। ছিপ হাতে কালো রঙের মার্বেল পাথরের মূর্তিটি নান্দনিকতার অনন্য উদাহরণ। বেঞ্চগুলো কোলকাতা থেকে আনানো হয়েছিল। এখন দর্শনার্থীরা পাহাড়ি কন্যা পাথরের মূর্তিটির এক হাত ভাঙা দেখতে পাবেন। অথচ একসময় তার হাতের কবজিটি স্বর্ণ দিয়ে বাঁধাই করা ছিল।

উত্তরা গণভবন চত্বরে গোলপুকুর, পদ্মপুকুর, শ্যামসাগর, কাছারিপুকুর, কালীপুকুর, কেষ্টজির পুকুর নামে ছয়টি পুকুর রয়েছে। এছাড়া, গণভবনের ভেতরের চারপাশে সুপ্রশস্ত পরিখা রয়েছে। প্রতিটি পুকুর পরিখায় শানবাঁধানো একাধিক ঘাট আছে।

বিভি/কেএইচ/ এনজি

মন্তব্য করুন: