ভারী শিল্পে, ভারী বিপদে বাঘ
রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বাংলার গর্বের প্রতীক। শুধু গর্ব নয়, দেশের সুরক্ষায়ও রয়েছে এদের অসামান্য অবদান। বাঘ টিকে আছে বলে টিকে আছে সুন্দরবন। সেই সুন্দরবন ঝড়-ঝঞ্ঝায় বুক পেতে দিয়ে দুর্যোগে রক্ষা করছে দেশের মানুষকে। সুন্দরবনের অক্সিজেন সরবরাহের কথা তো থাকলই।
নানান কারণে আজ হুমকিতে সুন্দরবন, হুমকিতে সুন্দরবনের গর্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সবশেষ ২০১৯ সালের জরিপের তথ্য বলছে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বিচরণ রয়েছে ১১৪টি বাঘের। যদিও ২০১৫ সালের জরিপের তুলনায় এই জরিপে ৮টি বাঘ বেড়েছে বলে তথ্য উঠে এসেছে। কিন্তু এর আগের জরিপগুলোতে ৪৫০টি পর্যন্ত বাঘের তথ্য উঠে এসেছিলো।
২০১০ সালের ২৯ জুলাই রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে বিশ্বের বন্য বাঘ আছে এমন ১৩টি দেশের প্রতিনিধিরা বাঘ রক্ষায় সম্মতি স্বাক্ষর করেন। যার উদ্দেশ্য ছিলো, ২০২২ সালের মধ্যে বন্য বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
সেই হিসেবে বাঘ দ্বিগুণ করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বাংলাদেশেরও। তাই বাঘ বাড়াতে নানান পদক্ষেপও নিয়েছে বন অধিদফতর। বন বিভাগের তৎপরতায় ইতিমধ্যে কমেছে বাঘ হত্যা ও বাঘ-মানুষ সংঘাতের ঘটনাও। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত ২৪ বছরে ২৪টি বাঘকে গুলি করে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই সময়ে ১০টি বাঘের স্বাভাবিক মৃত্যুর তথ্য মিলেছে। তবে গত কয়েকবছরে এই ধরনের ঘটনা অনেকটাই কমে এসেছে।
কিন্তু বর্তমানে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য সবচেয়ে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে তার আবাসস্থল অনিরাপদ হয়ে পড়া। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তায় কাজ করা গবেষকরা বলছেন, বাঘ শিকার বা হত্যা কমলেও বাঘের আবাস হারানোর শঙ্কা এখন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে সুন্দরবনের আশেপাশে গড়ে উঠা শিল্প কারখানাগুলো বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে বাঘের প্রজনন সুযোগও।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বন্যপ্রাণী গবেষক ড. মো. মোস্তফা ফিরোজ বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, সুন্দরবন ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে- এটি স্বীকার না করলেই নয়। এখন আমাদের বন বিভাগের অনেক তরুণ কর্মকর্তা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক এবং অভিজ্ঞ। এর সুফল আসছে সুন্দরবন থেকেও। যোগ্য ব্যবস্থাপনা ও স্মার্ট প্যাট্রোলিংয়ের পাশাপাশি বন বিভাগের নানান পদক্ষেপে বাঘের নিরাপত্তা বেড়েছে। তাছাড়া কোভিড-এর কারণে বনে ট্যুরিস্ট যাতায়াত নেই। এতে বাঘের সংখ্যা আরও বাড়ছে বলে আমরা ধারণা করছি। কিন্তু সুন্দরবনে ঘিরে যেভাবে শিল্প কারখানা নির্মাণ হচ্ছে তাতে বাঘের নিরাপদ পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এখন ক্লিংকর, কয়লাসহ বিভিন্ন ভারী বস্তুবাহী মাদার ভেসেলগুলো সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে যাতায়াত করছে। এসব জাহাজের শব্দ অবশ্যই বাঘের বিরক্তির কারণ হবে। যা প্রভাব ফেলবে তার প্রজননেও। তাই সরকার যদি সত্যিই বাঘ বাড়াতে চায় তাহলে এই বিষয়ে এখনি বিকল্প ভাবা প্রয়োজন।
সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মনিরুল এইচ খান। তিনি বলেন, সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে আমরা সম্ভাবনা দেখছি। এখনো বাঘ এবং হরিণের ক্ষেত্রে কিছুটা চোরা শিকারির উৎপাত আছে। এটি একটি বড় হুমকি। তাছাড়া, সরকার নির্ধারিত সুন্দরবনের বাফার এরিয়াতে চলছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ। এটা তো বহুদিন ধরেই আলোচনা হয়ে আসছে। বনের বাফার এরিয়াতে কোনো কারখানা নির্মাণই সমীচীন নয়। এটি সরকারের বাঘ সংরক্ষণের পদক্ষেপের বিপরীত।
এই বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল বলেন, আমরা করোনাকালে বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় দেখেছি মানুষের যাতায়াত বন্ধ হওয়ায় ক্যাপটিব বন্যপ্রাণীগুলোর সংখ্যা বেড়েছে। জাতীয় চিড়িয়াখানায় ধারণক্ষমতার বেশি হয়ে যাওয়ায় তাঁরা হরিণও বিক্রি করেছে। এটা প্রমাণ করে যেখানেই হোক না কেন, বন্যপ্রাণীদের বিরক্ত না করলে তাদের জীবনধারণ সহজ হয়, বাড়ে প্রজনন ক্ষমতাও। অথচ আমরা ইকো ট্যুরিজমের নামে সুন্দরবনে বাঘের টেরিটোরিতে মানুষকে ঢুকিয়ে দিচ্ছি। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শুধু ট্যুরিস্ট নয়, বাঘকে ভালো রাখতে হলে সুন্দরবনের ভেতরে সব কর্মযজ্ঞ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সুন্দরবনে বিভিন্ন এলাকায় সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দফতর করেছে। বনের খালে তাঁদের যাতায়াতও বাড়ছে। এতে নিশ্চয় বাঘসহ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তাই আগামীতে আর একটিও অফিস করতে না দেওয়ায় জোর দিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন পরিবেশ সচিব।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বলেন, সরকার সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণের লক্ষ্যে রক্ষিত এলাকার পরিমাণ আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। বাঘ শিকার প্রতিরোধে সুন্দরবনের মধ্যে জিপিএসের সাহায্যে 'স্মার্ট পেট্রোলিং' পরিচালনা করা হচ্ছে। সুন্দরবনে বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বন বিভাগ ড্রোন ব্যবহার করছে। বন্যপ্রাণীর সুপেয় পানির জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক মিঠাপানির পুকুর খনন করা হয়েছে। সুন্দরবনে বর্তমানের ১০০টি বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে কাজ করছে সরকার।
তিনি বলেন, কোভিডকালে সুন্দরবনে মানুষের উপদ্রব কম হওয়ায় বাঘের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু মানুষের জন্য বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবন এবং জাতীয় পশু বাঘের কোনো প্রকার ক্ষতি হতে দেওয়া হবে না। সুন্দরবনে বাঘের বসবাস উপযোগী নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিভিন্ন উদ্দেশ্যে সুন্দরবনে মানুষের প্রবেশ বন্ধ করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী।
বিভি/কেএস/এমএস
মন্তব্য করুন: