তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বাপা’র ৮ দফা দাবি
চলমান তাপপ্রবাহ থেকে পরিত্রাণ ও পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক করতে এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বাপা’র ৮ দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)। মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে “তাপদাহের তীব্রতাঃ দায় কার? করণীয় কি?” -শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
বাপা’র সভাপতি অধ্যাপক ড. নুর মোহাম্মদ তালুকদার এর সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির এর সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাপা’র সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব।
এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম, চেয়ারম্যান, ভুগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অধ্যাপক মিহির লাল শাহা, চেয়ারম্যান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ড. আব্দুস সালাম, অধ্যাপক রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রমূখ।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাপা’র সহ-সভাপতি মহিদুল হক খান, যুগ্ম সম্পাদক আমিনুর রসুল, হুমায়ুন কবির সুমন, নির্বাহী কমিটির সদস্য জাভেদ জাহান, জতীয় কমিটির সদস্য যথাক্রমে, হাজি শেখ আনসার আলী, গওহার নঈম ওয়ারা, আশরাফুল আলম চিশতি, মোনছেফা তৃপ্তি, ফাহমিদা নাজনিনসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদি ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
মূল প্রবন্ধে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, বর্তমানে নগরীগুলোতে তাপমাত্রা অনুভবের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধির চেয়ে অনুভবের মাত্রা বেড়েছে, কারণ পরিবেশ ও প্রতিবেশের সাথে সহনশীল সহমর্মিতায় সহাবস্থানের মানসিকতার প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণও তীব্রভাবে বেড়েছে। পাশাপাশি, ধনী-দরিদ্র বা সামর্থ্যবান-অসামর্থ্যবানদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধানের তীব্রতার প্রতিফলনই হচ্ছে এই অনুভবের প্রখরতা বৃদ্ধি। ফলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, আর প্রকারান্তরে এভাবেই অর্ধবিকলাঙ্গ একটি প্রজন্ম তৈরির যন্ত্রে পরিণত হয়েছে আমাদের নগর ও নগরায়ণ।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, দেশে বিপরীতমূখী উন্নয়ন চলছে। যা দেশ ও জনগনের জীবনের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা লক্ষ্য করছি যশোর রোডের গাছগুলো কাটার পাঁয়তারা চলছে। এইভাবে গত বছর ধানমন্ডির সাত মসজিদ গাছগুলো কাটা হয়েছে তথাকথিক সৌন্দর্য্যবর্ধনের অজুহাতে কি উন্নয়ন হয়েছে তা জনগন দেখছে। অথচ যশোর থেকে কলকাতার রাস্তার ধারের গাছগুলো সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন আমরা যদি প্রতিজ্ঞা করে পদ্মা সেতু করতে পারি তবে প্রতিজ্ঞা করে পরিবেশ রক্ষা করতে কেন পারবো না।
তাপ নিয়ন্ত্রণে ৮ দফা দাবীতুলে ধরা হয়। দফাগুলো হলো-
১. বন ও বনভূমি সুরক্ষায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/ অধিদপ্তর/ কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ, প্রণোদনা ও আইনভঙ্গকারীদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা।
২. সিটি কর্পোরেশন এবং সড়ক ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে ‘সম্প্রসারণ উন্নয়নে’র নামে বসবাসযোগ্য নগর পরিবেশ ধ্বংসে যেভাবে সচেষ্ট, তা থেকে তাদেরকে সম্পূর্ণ নিবৃত করে কার্যকর ‘সবুজায়ন নীতিমালা’র ভিত্তিতে সংরক্ষণ নিশ্চিত করে ভারসাম্যপূর্ণ এবং দেশজ বৃক্ষ রোপন ও লালনের কর্মসূচি কার্যকর করার পাশাপাশি ‘নগর বন’ সৃষ্টির ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ব্যক্তি ও কর্পোরেট ভিত্তিক সবুজায়ন ও বনায়ন উদ্যোগকে প্রণোদিত ও কখনো কখনো বিশেষভাবে উৎসাহিত করার প্রয়াস নিতে হবে।
৩. নগরব্যাপী বিদ্যমান পুকুর, খাল এবং অন্যান্য জলাশয় পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণপূর্বক নগরীর বাসযোগ্যতা উন্নয়নে সমন্বিতভাবে “নীল অন্তঃসংযোগ” গড়ে তোলার পাশাপাশি নদীর সাথে তাদের সংযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয় আশু উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি, নগরীতে বিদ্যমান পুকুর, জলাধার ও জল সংরক্ষণ উদ্যোগগুলোর ত্বরান্বিত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
৪. সমীক্ষানির্ভর নীতিমালা প্রণয়ন এবং প্রণোদনা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সাম্যতার ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্তিতার নগরদর্শন নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী ও সংস্থাগুলোকে নিয়ে আশু উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ব্যক্তি পর্যায়ে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি এবং জনমানুষকে নিয়ে প্রতিটি বাড়িতে তাপদাহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সামর্থ্যের জায়গাটি কাজে লাগানো প্রয়োজন।
৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচীর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সঠিক বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে বিধায় এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৬. যত্রতত্র নিয়ন্ত্রিত কাচের ভবনের ‘আত্মঘাতী সংস্কৃতি’র বিপরীতে প্রকৃতির নির্ভরতায় জীবন আচরণ নিশ্চিতের ‘নগর দর্শন’ভিত্তিক বিনির্মাণ নিশ্চিতে অনতিবিলম্বে ‘ইমারত নির্মাণ বিধিমালা’য় যথোপযুক্ত শুদ্ধিকরণের উদ্যোগ প্রয়োজন। যদিও রাজউক তাড়াহুড়া করে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী এবং অংশিজনদের সাথে পরামর্শ গ্রহণ ব্যতিরেকে পাশ কাটানোর চেষ্টা মাধ্যমে সেই সুযোগকেও হত্যা করার চেষ্টা করছে। আশু উদ্যোগের মাধ্যমে তা প্রতিহত ও যথাযথ করা প্রয়োজন।
৭. নগরীতে বায়ু ও গ্যাসীয় দূষণের প্রধান প্রধান নিয়ামকসমূহ যেমন, অনুপোযোগী যানবাহন চলাচল, নির্মাণ কার্যক্রম ও মালামালের পরিবহন ও প্রক্রিয়াকরণ জনিত দূষণ, ইটভাটাজনিত দূষণ, ময়লার ভাগাড়, কারখানার নির্গত ধোঁয়াসহ অন্যান্য বায়ু দূষণকারী কার্যক্রম রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কার্যকরী ও দৃষ্টান্তমূলক দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ। সরকারী-বেসরকারী স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান দ্বারা গৃহীত প্রকল্পের আওতায় নগর বায়ু ও বর্জ্য দূষণ এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার অভিঘাতের বিরুদ্ধে অভিযোজন ও ভারসাম্য নিশ্চিতের কর্মসূচীগুলোকে সুবিন্যস্ত ও সুপরিকল্পিতকরণের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী করে তোলা জরুরী বিবেচনায় অন্যতম দাবী।
৮. সামগ্রিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে পরিবেশবাদী, পেশাজীবীসহ সকলের সম্মিলিত ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রচেষ্টায় ২০৩০ সালে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জন্য একটি সবুজায়ন নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। ইউএসএইড, বন অধিদপ্তর এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো মিলে বৃক্ষশুমারী করেছে। সেই আলোকে দেশব্যাপী সুপরিকল্পিত নগর সবুজায়ন নীতিমালা ভিত্তিক বাস্তবায়ন কর্মসূচির উদ্যোগ গ্রহণ করাই সমিচীন।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: