• NEWS PORTAL

  • মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট ২০২৫

Drama: Jamai Bou Chor
Drama: Jamai Bou Chor

জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণে মাছ মরছে বঙ্গোপসাগরে

ইমরুল কায়েস

প্রকাশিত: ১৮:২২, ৯ আগস্ট ২০২৫

আপডেট: ২০:০১, ৯ আগস্ট ২০২৫

ফন্ট সাইজ
জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণে মাছ মরছে বঙ্গোপসাগরে

বঙ্গোপসাগরের এভাবে তীরে ভেসে আসছে মরা মাছ। ছবি- বাংলাভিশন

কয়েক দিন আগে ঘুরতে গিয়েছিলাম কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে। পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত। সৈকতে হাঁটতে গিয়ে দেখি বালুর ওপর মাছ মরে পড়ে আছে। কাছে গিয়ে মাছ হাতে নিয়ে দেখলাম। চিনতে পারলাম না। তবে ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে পরে জানতে পারি এটি বিরল প্রজাতির ইউনিকর্ন লেদার জ্যাকেট মাছ। সাধারণত বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র উপকূল এবং মেঘনা নদীর মোহনায় এ মাছ দেখতে পাওয়া যায়। সৈকতে থাকা স্থানীয় লোকজনকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। তারা জানায় অনেক মাছ মরে ভেসে উঠেছিল। তবে ঢেউয়ের তোড়ে মরা মাছগুলো আবার পানিতে ভেসে গেছে। 

স্থানীয়দের কাছ থেকেই জানতে পারি মাঝে মাঝেই এরকম সমুদ্রের মরা মাছ ভেসে ওঠে। অর্থাৎ সমুদ্রোপকূলে মাছ মরার ঘটনাটি তাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক। মাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক সম্পদ। সামুদ্রিক মাছ দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদার একটা বড় অংশ পুরণ করতে পারে। তাই মাঝে মাঝে মাছ মরার এ তথ্যটিতে আহত হই। এভাবে চলতে থাকলে তো বাংলাদেশের মৎস্য খনি বঙ্গোপসাগরের মাছ একসময় উজাড় হয়ে যাবার ঝুঁকি রয়েছে। 

বিশেষ করে যেগুলো বিরল প্রজাতির মাছ সেগুলো নি:শেষ হয়ে যেতে পারে। সমুদ্র বিজ্ঞানী ও প্রাণী সম্পদ বিশেষজ্ঞদের মতে মূলত কয়েকটি কারণে সমুদ্রের মাছসহ জলজ প্রাণী মারা যেতে পারে। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, রাসায়নিক, পলিথিন, প্লাস্টিক ও তেলজাতীয় বর্জ্য নি:সরনের ফলে মারাত্মক দূষণ এবং এর ফলে পানিতে অক্সিজেন কমে যাওয়া। 

অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বঙ্গোপসাগরেও পড়ছে। যেভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে তাতে বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। স্বাভাবিকের চেয়ে বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা বাড়ায় বিরল প্রজাতির ইউনিকর্ন, ডলফিনসহ অন্যান্য প্রজাতির মাছ মরে যাচ্ছে। কুয়াকাটা এবং কক্সবাজারের মতো সমুদ্র সৈকতে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক পর্যটক অবকাশ যাপন করতে যান। তারা সৈকতের তীরবর্তী পানিতে গোসলসহ আনন্দ ফুর্তি করেন। সৈকতে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকরা প্লাস্টিক বা পলিথিন জাতীয় বস্তু অবাধে সমুদ্রের পানিতে ফেলে দেন। এতে সমুদ্রের পানির দূষণ বেড়ে যাচ্ছে। 

তাছাড়া কর্ণফুলি, মেঘনা, মাতামুহরী, হালদা, বাকখালীসহ বিভিন্ন নদীপথ দিয়ে নানা ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য, শিল্প ও মানব বর্জ্য প্রতিনিয়ত পড়ছে বঙ্গোপসাগরে। নদীপথে প্রতিদিন টনকে টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরের পানিতে মিশছে। বিশেষকরে কর্ণফুলি নদীর তীরে বড় বড় সার ও রাসায়নিক কারখানাসহ প্রায় শত শত ছোট ও ভারি শিল্প কারখানা রয়েছে। এসব শিল্প কারখানার বর্জ্য কর্ণফুলি নদী দিয়ে সরাসরি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। ফলে সাগরের পানি দূষণের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। 

বছর দুই আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একদল গবেষক বঙ্গোপসাগরের দুষণ নিয়ে গবেষণা করে। সেসময় ওই গবেষক দলের জীববৈচিত্র বিষয়ক গবেষক জেনা জ্যামবেক ও হিথার কোল্ডওয়ে তাদের দল নিয়ে পদ্মা নদী থেকে সাগরের প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে জরিপ চালায়। জরিপ শেষে গবেষক হিথার কোল্ডওয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছে উল্লেখ করেন বঙ্গোপসগারের দুষণে প্রধান ভূমিকা রাখছে প্লাস্টিক বর্জ্য। প্রতিবছর ৯০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য নদীতে গিয়ে পড়ে। এসব পণ্য ভেসে ভেসে সাগরে গিয়ে পড়ে পানি দুষণ করছে। 

জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইউএনইপি’র ‘বিশ্বের প্লাস্টিক ব্যবহার পরিস্থিতি’ শীর্ষক  একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,  বিভিন্নভাবে প্রতিদিন ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। মাছের পেটের মধ্যে প্লাস্টিক পণ্য পাওয়ার কথা উপকূলের জেলেরাও স্বীকার করেন। 

সমুদ্রগামী জাহাজ থেকে চুইয়ে পড়া তেলেও দূষিত হচ্ছে সাগরের পানি। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের জাহাজ ভাঙার বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থে দূষণ, কর্ণফুলির মোহনা ও বহির্নোঙর জুড়ে ক্রমেই তেল দূষণ বাড়ছে। বহিঃনোঙর থেকে জ্বালানী তেল খালাসের সময় তেল নিঃসরণ হয়। সেই তেল বঙ্গোপসাগরের পানিতে মিশে দূষণের সৃষ্টি করে। আবার অনেক জাহাজ বহিঃনোঙরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার সময় তেল নিঃসরণ হয়ে পানিতে মিশে যায়। 

এরকম নানাভাবে বঙ্গোপসাগরের পানি দূষিত হচ্ছে। এর ফলে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র। মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী পানিতে টিকতে পারছে না। পানি দূষণের কারণে ধীরে ধীরে বিরল প্রজাতির মাছগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। 

এ বিষয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, দূষণের কারণে পানিতে জলজ প্রাণী বসবাসের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। ফলে মাছসহ অন্যান্য প্রাণী মারা যায়। 

এর আগে সমুদ্রোপকূলে মরা তিমি মাছ ভেসে আসার খবরও পাওয়া গেছে। গত দুই বছরে ৬১ ডলফিন এবং ৬টি মরা তিমি ভেসে আসে। পানি দূষণের কারণেই যে এসব মাছ মরছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দূষণের কারণে উপকূল এলাকার মৎস্যসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর জীবন বিপন্ন হচ্ছে। দূষণ বিপর্যয়ে হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র। এ থেকে সাবধান এবং সতর্ক না হলে বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলজ সম্পদ হুমকির মুখে পড়তে পারে। 

পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এ ব্যাপারে সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বঙ্গোপসাগরের মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি টিম গঠণের পরামর্শ দেন তিনি। 

বঙ্গোপসাগরের দূষণ রোধে অবশ্যই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বঙ্গোপসাগর এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষায় সবাইকে সচেতন হতে হবে। মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণ রোধ করার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তণের প্রভাব মোকাবেলায় সরকারসহ অংশীজনদের একযোগে উদ্যোগ গ্রহণ করার বিকল্প নাই।

বিভি/এজেড

মন্তব্য করুন: