• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

জাদুময় সেই দিনরাতগুলো

জসিম মল্লিক

প্রকাশিত: ১৯:৪২, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২

ফন্ট সাইজ
জাদুময় সেই দিনরাতগুলো

জসিম মল্লিক

প্রতিটা মানুষের মধ্যেই একটা নির্জণতা আছে, একটা একলা মন আছে। প্রতিটা মানুষই কখনও না কখনও নিঃসঙ্গ ও একা। যখন চারিদিকে সবাই ঘিরে থাকে তখন মনে হয় জীবন কানায় কানায় পূর্ণ। সফল মানুষের সুবিধা হচ্ছে তাঁকে ঘিরে থাকার মানুষের অভাব হয় না। কিন্তু ব্যর্থতার চক্রে যার জীবন বাঁধা পড়ে আছে সে সবসময় একলা, নিঃসঙ্গ। কিন্তু সফল মানুষটিও কোনো একসময় একলা অনুভব করেন। কোনো এক নির্জন মুহূর্তে তারও মনে হয়, তার কেউ নাই। আসলে প্রতিটি মানুষ একলা। আমরা পরিবার, বন্ধু, আত্মীয় নিয়ে বাঁচতে চাই, উৎসব করতে চাই, লতিয়ে, পেঁচিয়ে, জড়িয়ে থাকতে চাই। কিন্তু কখনও কি নিজেকে প্রশ্ন করেছি আমার আত্মার অস্তিত্ব কি! আমি কোথা থেকে এসেছি কোথায় যাব কখনও কি জানার চেষ্টা করেছি! বেঁচে থাকা জীবনে মানুষ কত কি করে। এক এক জনের জীবন দর্শন এক এক রকম। আমি আমার শৈশব কৈশোর থেকেই প্রবল অনুভূতি সম্পন্ন ছিলাম। ছোট খাট ঘটনা, ছোট ছোট অবহেলা, ছোট ছোট অভাব, ছোট ছোট কথা আমাকে নাড়া দিয়ে যেতো প্রচন্ডভাবে। আমাকে প্রভাবিত করত। 


শৈশবের প্রতিটি মুহূর্ত আজও আমি মনে করতে পারি। আমি সহজে কিছু ভুলি না। বরিশালের শুভ্র সবুজের মধ্যে আমি বেড়ে উঠেছি। বাড়ি ভরা মানুষ ছিল আমাদের, খেলার সাথীরা ছিল। বড় পরিবার আমাদের। বিশাল বড়। শহরে একনামে চেনে সবাই। মল্লিক বাড়ির পুল বললে রিক্সাওয়ালা একটানে নিয়ে আসত। ডানে বাঁয়ে তাকাতে হতো না। আমাদের আগের জেনারেশন যারা আমার বড় দুই ভাই বা বাড়ির অন্য তরুনরা, মহল্লার আরো যারা যুবক ছিলেন তাদের মধ্যে আমি প্রবল একটা সাংস্কৃতিক চেতনা দেখেছি। শুদ্ধ চিন্তার ব্যাপার লক্ষ্য করতাম। পাকিস্তান আমল থেকেই আমাদের বাড়িতে রেজিষ্টার্ড লাইব্রেরি ছিল। নাম ছিল ইকবাল পাঠাগার এন্ড ক্লাব। সেখানে বই ছিল, সংবাদপত্র রাখা হতো। খেলাধুলার ব্যবস্থা ছিল। আমরা ছোটরা সেখানে যেতাম নিয়মিত। আমাদের বাড়ির খেলার মাঠে ফুটবল, হাডুডু, হকি খেলার প্রতিযোগিতা হতো। রাতে লাইট জ্বেলে ব্যাডমিন্টন, ভলিবল খেলা হতো। নৌকা বাইচ, ঘোর দৌড়, পোলো, সাঁতার প্রতিযোগিতা হতো। বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা করতাম। 

বড়রা অবসরে যাওয়ার পর আমরা  কয়েকজন কিশোর মিলে হাল ধরেছিলাম। মহল্লার সব শিশু কিশোরদের একত্রিত করেছিলাম। এখন যেমন পাড়া মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড় উঠেছে, তারা নিষ্ঠুরতা করে, অন্যদের আঘাত করে, ছুড়ি চাকু চালায়, ড্রাগ নেয়, ইভটিজিং করে। আমাদের সময় ওসবের চল ছিল না। আমরা দূর থেকে স্কুলের মেয়েদের দেখতাম। চোখে চোখ পড়লে মুচকি হাসতাম এই পর্যন্তই।  আমি স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতাম, লাইব্রেরি থেকে বই এনে পাঠ্য বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম। অন্যরা বাবা মায়ের সুবোধ বালক ছিল। আমি তা ছিলাম না। আমি ছিলাম আউলা ঝাউলা, ভাবুক আর অনুভূতিপ্রবন। তখন আমরা ছোটরা রাত জেগে বড়দের নাটকের রিহার্সাল দেখতাম। যাত্রাপালার আয়োজন করত আমাদের বাড়ির খোলা জায়গায়। যাত্রার দল আসত। তখন নাটকে আমাদের ছোটদের পার্ট দেওয়ার আশা দিত। আমাকেও একবার বলেছিল পার্ট দেবে। অভিনয়ের চিন্তায় এবং টেনশনে আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না। যদিও পরে কোনো এক অদৃশ্য কারণে শিশু চরিত্র থেকে আমার নাম বাদ গেছিল। আমি হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। মঞ্চে উঠে আমি কি করব সেই ভয়ে আমি ঘামতাম। এখনও মঞ্চে বা টিভির সামনে গেলে আমার এমন অনুভূতি হয়। শৈশবের সেই ভীতি আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। 
একটা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে আমি বড় হয়েছি। বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরীর আমি ছিলাম সর্ব কনিষ্ঠ পাঠক। মেম্বারশিপ ছাড়াই আমি বই আনতে পারতাম। কোনো এক অদৃশ কারণে লাইব্রেরিয়ান চাচা আমাকে পছন্দ করতেন। ছোটদের বই পড়তে দিতেন। কোনো কোনো বই একবারে দিয়ে দিতেন, আর ফেরত দিতে হতোনা। এছাড়াও বরিশালে তখন ছিল বুক ভিলা নামক বিখ্যাত বইয়ের দোকান। সেই দোকানের মালিকের সন্তান ছিল আমার স্কুল ফ্রেন্ড। সেই সুবাদেও আমি বই পড়ার সুযোগ পেতাম। বই পড়া আর সিনেমা দেখার নেশায় পেয়ে বসল আমাকে স্কুল থেকেই । তার আগে পর্যন্ত আমি পাড়ার দুষ্ট ছেলেদের  সাথে ঘুড়ি ওড়ানো, কেটে যাওয়া ঘুড়ির পিছনে দৌড়ানো, সুতায় মাঞ্জা দেওয়া এসব করেছি। মার্বেল খেলতাম, সিগারেটের কাগজ দিয়ে চাড়া খেলতাম, সাইকলের রিং কাঠি দিয়ে রাস্তায় চালাতাম। এমনকি বিড়িও ফুঁকেছি। প্রায় উচ্ছন্নে যাওয়া সন্তানে পরিণত হয়েছিলাম আমি। আমার দুরন্তপনার জন্য মাকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। অন্যদের ছেলেদের আমার সাথে মিশতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। যদি তারা নষ্ট হয়ে যায়! তারপর একদিন হঠাৎই আমি অন্য এক জগতের সন্ধ্যান পেলাম। সেটা হচ্ছে বই। স্কুলের এক বন্ধু বই ধরিয়ে দিয়েছিল আমার হাতে। সেই থেকে ওসব দুরন্তপনা ছেড়ে দিলাম। মা অন্যদের কথা শোনার হাত থেকে মুক্তি পেলেন।

মায়ের সঙ্গে জসিম মল্লিক

রাতে যে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ি মা টের পেয়ে গেলেন একদিন। দস্যু বনহুর, দস্যু মোহন আর কুয়াশা সিরিজের বই পড়ি। মেইন সুইজের কাট আউট খুলে নিতেন মা। যেনো লাইট জ্বালাতে না পারি।  প্রায়ই বলতেন, বাপ মরা ছেলে লেখাপড়া না শিখলে খাবে কি! আর কাঁদতেন। একবার স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখে এসে মায়ের হাতে ধরা পড়ে গেলাম। মা দড়ি দিয়ে দুই পা উঁচু করে দাড় করিয়ে হাত বেঁধে দাড় করিয়ে রেখেছিলেন। সেবার আমার বোন সাজু আমাকে রক্ষা করেছিল। আমি যা করতাম সবকিছুতে সাজুর সায় থাকত। আবার দুজনে ঝগড়াও করতাম। পিঠাপিঠি ছিলাম যে আমরা! মনে আছে একদিন প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। বিউটি সিনেমা হলে ময়না মতি চলছে। আমাকে দেখতেই হবে। বৃষ্টিতে ভিজে কিভাবে যাব! আমারতো কোনো ছাতা নাই। তাই সেদিন রিক্সার পিছনে ঝুলে ঝুলে গিয়েছিলাম। রিক্সাওয়ালা চাচা টের পেলেই বকা দিচ্ছিলেন। অই  ছ্যামরা নাম রিক্সা দিয়া! তখন নেমে দৌড়াতাম। আবার রিক্সার পিছনে ঝুলতাম। এভাবেই সিনেমা হল পর্যন্ত গিয়েছিলাম।
বই আমাকে বদলে দিল। বই আমাকে নির্জন করে দিল। বই আমাকে নিঃসঙ্গ করে দিল, বই আমাকে দুঃখী করে দিল। বই আমাকে দলছুট আর প্রথা বিরোধি করে দিল। আমি একলা বাঁচার একটা জগত খুঁজে পেলাম। সবার মধ্যে থেকেও যেনো আমি নেই। কোথাও নেই। আমি শৈশব থেকেই টের পেতাম আমার মধ্যে আলাদা এক আমি আছে। আমি বুঝতে শুরু করলাম মানুষ আসলে নিষ্ঠুর, মানুষ আসলে আত্মকেদ্রিক, মানুষ স্বার্থপর। একসময় আমি দূরের মানুষের সাথে কমিউনিকেশন শুরু করলাম পত্রমিতালীর মাধ্যমে। আমার কাছে শত শত চিঠি আসত। আমার জন্য একটা সাব পোষ্ট অফিস পর্যন্ত খোলা হয়েছিল। মানুষকে জানার এক প্রবল নেশা তৈরী হলো আমার মধ্যে। নারীদের প্রতি দুর্বল আমি তখন থেকেই। এর কারণ আমার মা। এর কারন আমার বোন সাজু। এর কারন আমাদের বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা। আমি দেখতে সুন্দর ছিলাম বলে রুবির নেতৃত্বে আমাকে মেয়ে সাজিয়ে একবার মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। মা আমাকে চিনতেই পারেননি। আমি তাদের ছায়ায় বড় হয়েছি। আজ এতোটা বয়সেও আমার সেই উড়ু উুড়ু মন রয়ে গেছে। বিবাগী মন আমার। আজও আমি নারীদের প্রতি দুর্বল। এর কারনও আমার স্ত্রী, আমার মেয়ে অরিত্রি, আমার নারী সব পাঠক, আমার নারী বন্ধু, নারী আত্মীয়। আমি তাদের কাছ থেকে অনেক আনুকল্য পাই। আমি যা বলি অরিত্রি তাই করে দেয়। কালকে বলেছে তোমার যেখানে যেতে মন চায় যাও। আমি ব্যবস্থা করে দেবো। আমাকে ২২০০ ডলারের এয়ার কানাডার একটা ভাউচার দিয়েছে। এটাকে আমি রিডিম করতে পারব।

আমার জীবনটা অনেক লড়াই সংগ্রামের। কৈশোর কাল ছাড়াও ছাত্র জীবনে আমি সংগ্রাম করেছি। সেই সময় মানুষের ভালবাসা যেমন পেয়েছি উপেক্ষাও দেখেছি। ক্ষুধার কষ্ট দেখেছি। একটা দুটা প্যান্ট শার্ট দিয়ে বছর পর বছর পার হয়েছে আমার। সুন্দর সুন্দর মেয়ে সহপাঠি ছিল আমার। সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন ছিল বরিশালেও ছিল। তারা আমাকে ঘিরে থাকত। কিন্তু ভাল পোশাক আশাক ছিল না বলে ওদের সামনে স্বচ্ছন্দ হতে পারতাম নি। কিন্তু তারা আমাকে সহজভাবে নিয়েছিল। আমার অন্য ছেলে বন্ধরাও আমাকে গ্রহন করেছিল। জীবনের প্রতিটা পড়তে পড়তে রয়েছে নানা ঘটনা। সিনেমার মতো। স্বপ্ন ও প্রত্যাশার এক আশ্চর্য্য মিশেল আমাদের এই জীবন। অনেক অবহেলা যেমন পেয়েছি মানুষের কাছ থেকে তেমনি ভালবাসা পেয়েছি তার বহুগুন। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি পেয়েছি। 
অনেকেই আমাকে আঘাত করেছে, ঠকিয়েছে কিন্তু সেসব আমাকে গুড়িয়ে দিতে পারেনি। আমি কখনও প্রত্যাঘাত করিনি, প্রকৃতি আমাকে রক্ষা করে সবসময়। কেউ আমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। কারো প্রতি কোনো ক্ষোভ বয়ে নিয়ে বেড়াই না আমি। আমার সাথে কেউ ছলচাতুরির আশ্রয় নিলে আমি ঠিক টের পাই। আমি আগে থেকেই অনেক কিছু বুঝতে পারি বলে আমি জীবনে অনেক অঘটন থেকে রেহাই পেয়েছি। আমি আমার জীবনের দুঃখ, কষ্ট, অবহেলা আর অপ্রাপ্তিগুলো নিয়ে কখনও আদিখ্যেতা করিনি। ওসব জীবনেরই অংশ। দুঃখ কষ্ট আর অপ্রাপ্তিগুলোকে আমি আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছি। আমি কিছু লুকোইনা। হাইড এন্ড সিক নাই আমার মধ্যে। আমি অকপট। আমার হারানোর কিছু নাই। তাই আমার জীবনে সবকিছু ছাপিয়ে আনন্দটাই বেশি, প্রাপ্তিটাই বেশি। 
চারিদিকের অনেক আয়োজন আছে, সাফল্য গাঁধা আছে আবার অপ্রাপ্তি আছে, ব্যর্থতাও আছে। তারমধ্যেই মানুষ তার নিজস্ব ভূবন গড়ে নেয়। আলাদা একক। আলাদা সত্ত্বা। যদি লেখালেখি না থাকত তাহলে জীবন কঠিন হতো। আমি লিখে আনন্দ পাই। আমি এবং আমার লেখা যেনো যমজ ভাই।
মারুফুল ইসলামের আজ বরং একটা গল্প বলি কাব্যগ্রন্থ থেকে কয়েকটি লাইন দিয়ে শেষ করছি,
”বেলা যতই গড়িয়ে যাচ্ছে পুব থেকে পশ্চিমে
সেইসব স্মৃতির সুধা উপচে পড়ছে
জীবনপাত্র থেকে 
আহা আমার মধুময় সেই দিনরাতগুলো
আহা আমার জাদুময় সেই দিনরাতগুলো..”


টরন্টো ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২

মন্তব্য করুন: