• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

আট আনার ঋণ

জসিম মল্লিক

প্রকাশিত: ১৪:৪০, ৩০ আগস্ট ২০২৩

ফন্ট সাইজ
আট আনার ঋণ

ছোটবেলা থেকেই সিনেমার প্রতি আমার তীব্র নেশা । আমার মতো সিনেমা পাগল মানুষ খুব বেশী নাই। আমার মা চাইতেন আমি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট হই। আর আমি যখন যাকে যেটা করতে দেখতাম সেটাই হতে চাইতাম। আমি জীবনে বিভিন্ন সময় যা যা হতে চেয়েছি তার একটা তালিকা দিচ্ছি- ১. নৌকার মাঝি ২. সারেং ৩. বাস ড্রাইভার ৪. দর্জি ৫. মেরিন ৬. সিনেমা হলের গেটম্যান ৭. ববিতার বাগানের মালি এবং ৮. অভিনেতা। সবগুলোর পিছনেই একটা করে ছোট্ট ইতিহাস আছে। একবার হলিউডে অস্কার নমিনেশন প্রোগ্রামে যোগ দিয়েছিলাম। সে অনুষ্ঠানে হলিউডি অনেক তারকাদের সামনা সামনি দেখেছিলাম। সিনেমা দেখা নিয়ে অনেক গল্প আছে আমার জীবনে। 


আমার ছোটমামা একটু আজব টাইপ মানুষ ছিলেন। থাকতেন ঢাপর কাঠি। অজগ্রাম। মাঝে মাঝে বরিশালে আমাদের বাড়িতে আসতেন। মামা সে সময় একমাত্র মেট্রিক পাশ মানুষ ছিলেন পুরো গ্রামের মধ্যে। মেট্রিক পাশ বলে একটু দাপুটে ছিলেন। বেশ সৌখিন মানুষ। কিন্তু মামা জীবনে আমার মতো কিছুই হতে পারেন নি। মামা আমাদের বাড়িতে এলে একটা উৎসব উৎসব ভাব চলে আসতো। মা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ছোট ভাইকে নিয়ে। আমিও মহা খুশী হতাম। কারন মামা যে ক’দিন থাকতেন আমার পড়াশুনা করতে হতো না। মামার পিছন পিছন ঘুরতাম। মা কিছু বললে মামা প্রোটেকশন দিতেন। 



তখন আমি অনেক ছোট। মামা একদিন আমাকে বললেন সিনেমায় যাবি জসিম! শুনে আমার বুকের মধ্যে দশটা ব্যঙ লাফ দিয়ে উঠল! স্কুলে যাওয়ার সময় দেখতাম রিক্সায় মাইক লাগিয়ে কী সুন্দর করে টেনে টেনে সিনেমা মুক্তি পাওয়ার কথা বলছে..”আজ ম্যাটিনি শোতে সোনালী সিনেমায় চলবে রাজ্জাক শবনাম অভিনীত নাচের পুতুল।" দেয়ালে দেয়ালে নায়ক নায়িকার ছবি সম্বলিত পোষ্টার। আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকি। সিনেমা জিনিসটা যে কেমন! কবে যে দেখতে পাবো! কয়েকবার সিনেমা হলের সামনে দিয়ে ঘুরেছি। ওই বয়সে আমার সিনেমা দেখা ছিল নিষিদ্ধ। তাছাড়া পয়সা পাবো কোথায়! 
মামাকে সেদিন মনে হলো ভিন গ্রহের একজন মানুষ। মামা আমাকে সিনেমায় নিয়ে যাবে! সত্যি যাবে তো!  কবে কখন তা আর জিজ্ঞেস করতে সাহস পাই না। যদি আমার স্বপ্নভঙ্গ হয়! সেদিন রাতে আমার আর ঘুম হয় না। তার পরের রাতেও না। মামাও কিছু বলে না। মামা ওইরকমই মানুষ। কোনো কিছুতেই মামা সরিয়িাস না। একটা কিছু প্লান করলে তা করতে করতে অনন্তকাল কেটে যায় মামার। সেই মামা আমাকে সিনেমা দেখার স্বপ্ন দেখালো। সত্যি সত্যি আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে মামা একদিন সিনেমায় নিয়ে গেলো। আমার জীবনের প্রথম দেখা সিনেমাটা ছিল রাজ্জাকের। নাম ছিল বড় বউ। 
ছোটমামা আজ আর নেই। কিন্তু তিনি যে বীজ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন আমার মধ্যে তার প্রভাব খুবই তীব্র হয়েছিল। চোখের সামনে সারাক্ষন ঘুরে বেড়াচ্ছে রুপালী পর্দায় দেখা সেইসব স্বপ্নের মানুষেরা। কিছুতেই মাথা থেকে সরানো যায় না। আবার কবে যেতে পারবো! এক একটা সিনেমা মুক্তি পায় আমার অদেখাই থেকে যায়। আমি বিষন্ন মনে ঘুরে বেড়াই। নিজেকে নিঃস্ব মনে হয়। পড়াশুনায় মন বসে না। আমি কেনো গেটম্যান হতে চেয়েছিলাম সেটা বলি। অভিরুচি সিনেমা হলে সাত্তার নামে একজন গেটম্যান ছিলেন। তার সাথে এক আধটু খাতির পাতিয়ে ফেললাম। সে খেয়াল কৱেছিল আমি তার আশ পাশ দিয়ে ঘুরি। সে সদয় হয়ে মাঝে মাঝে পাঁচ দশ মিনিটের জন্য আমাকে হলের ভিতরে ঢুকিয়ে দিত। ব্যস ওইটুকুই। তাতে আমার অতৃপ্তি আরো বাড়তো।



আমি আর আমার অকাল প্রয়াত বোন সাজু মিলে একবার ঠিক করলাম রাজ্জাক-ববিতার ’স্বরলিপি’ ছবিটা দেখতে যাবো। মাকে হাত পা ধরে রাজী করালাম। সেবার আমরা সিনেমা দেখে এসে বড় ভাইয়ের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি দমবার পাত্র নই। আমার সাহস বেড়ে যেতে থাকল। মা যা পয়সা দিত স্কুলে টিফিনের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না সিনেমা দেখার জন্য। একবার গেলাম রাজ্জাক শাবানার ’প্রতিশোধ’ সিনেমাটা দেখতে। ঈদের ছবি। প্রচন্ড ভীড়। টিকেট ব্ল্যাক হচ্ছে। আমার পকেটে পর্যাপ্ত পয়সা নাই। রিয়ার স্টলের টিকেটের দাম হাঁকাচ্ছে আড়াই টাকা। কী করি। সিনেমা না দেখে ফিরে যাবো! আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বসে আছি। 
একটা লোক কাছে এসে বলল, এই ছেলে কি হইছে! 
আমি বললাম আষ্ট আনা হইলেই আমি টিকিট কাটতে পারতাম। 
সেই লোক আমাকে আট আনা দিয়েছিল..। 
সেই মানুষটিকে আর খুঁজে পাব না। জীবনে এই একটা আৰ্থিক ঋনী হয়ে থাকলাম।

মন্তব্য করুন: