• NEWS PORTAL

  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

আমার একটা নদী ছিল.. 

জসিম মল্লিক

প্রকাশিত: ০৮:৩৮, ৩১ অক্টোবর ২০২২

ফন্ট সাইজ
আমার একটা নদী ছিল.. 

সংগৃহীত ছবি

আমি সবসময় একটা নদীর স্বপ্ন দেখি। একটা খুব বড় নদী, তার এপার ওপার দেখা যায়না। তার একধারে একটা বিরাট বালিয়াড়ি, আর একটা স্টিমার বাঁধার জেটি। সেখানে কেউ নেই। বালির ওপর একটা কেবল সাপের খোলস পড়ে আছে। মা মারা যাওয়ার পর থেকেই এই স্বপ্ন দেখি আমি। একদিন ঘুমের মধ্যে ওই স্বপ্ন দেখে জেগে উঠি। আবার ঘুমোই, আবার সেই স্বপ্ন। বারবার স্বপ্নটা দেখে আর ঘুম হয় না। ভয় পেতে থাকি। শুধু উঁচু বালিয়াড়ি, ধু ধু বালি গড়িয়ে নেমে গেছে, বালির শেষে দূর থেকে একটা কালো জেটি দেখা যায়। তারপর জল। খুব অথৈ জল, অনন্ত জল। প্রকান্ড নদীটা, তার ওপর কালো আকাশ ঝুঁকে আছে..


যখন আমি কিশোর। মায়ের সাথে নৌকোয় চড়ে আমি অনেকবার ঢাপরকাঠি থেকে বরিশাল এসেছি। ছোটবড় অনেকগুলো নদী ছিল তখন। তার মধ্যে একটা নদী ছিল খুব বড়। একদিন খুব ঝক ঝকে সকালে আমরা নৌকোয় চড়ে রওয়ানা হলাম। নৌকোর মধ্যে চাল, ডাল, সুপুরি। নৌকায় পাল তুলে দু’জন মাঝি গুন টেনে চলেছে। কী সুন্দর নদীর ঝক ঝকে জল ছিল। ঝিক ঝিক রোদের আলো পড়ে ঝকমকিয়ে ওঠেছিল জেলেদের সদ্য ধরা ইলিশ। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে উঠেছিল! আমরা তখন সেই বিশালাকায় নদীতে। শুরু হয়েছিল বৃষ্টি! আর সেই সাথে ঝড়! প্রচন্ড দুলুনিতে নৌকোটা বারবার কাত হয়ে যাচ্ছিল! সেটা এক দারুণ ঝড়। প্রচন্ড ছিল বাতাসের গতি। আমি ভয় পেয়েছিলাম! মা আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিল! বলেছিল কোনো ভয় নেই..।
এখন আমার স্বপ্ন আছে। সেই নদীর স্বপ্ন। মনে হয় আমি যেন উঁচু বালির চুড়ায় বসে আছি। অনেক দূর পর্যন্ত বালিয়াড়ি গড়িয়ে গেছে-আধমাইল-একমাইল-তারপর ঘোলা জল-একটা জেটি প্রকান্ড নদী দিগন্ত পর্যন্ত। রাতের স্টিমারঘাট-কেবল কিন্দু বিন্দু আলো জ্বলে, জেটির গায়ে জলের শব্দ ওপারে ভীষণ অন্ধকার। এক নিস্তব্দতাকে শুনি। গভীর নিস্তব্দতা। সেই নিস্তব্দতায় খুব উঁচু থেকে বালিয়াড়ি নেমে গেছে বহু দূর। ধু ধু বালিতে শব্দহীন জ্যোৎস্না পড়ে আছে। হাড়ের মতন সাদা বালি-গড়ানে-তারপর অন্ধকার জেটি, ঘোলা জল। শেয়ালের চোখের মতো চকচক করে ওঠে জোনাকিপোকা। সেখানে বাতাসের শব্দ নেই, জলের শব্দ নেই। বালির ওপর একটা সাপের খোলস পড়ে থাকে।
মানুষের স্মৃতি থেকে সহজে কিছু মুছে যায় না। যেমন সেই নদীটা বারবার ভেসে উঠে। নানা ব্যঞ্জনায়। কৈশোরে আমি সেই নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকতাম। মায়ের সাথে কতবার সেই নদী দিয়ে কত জায়গায় গিয়েছি। ছিল একটা জেটি আর ঘাট। স্টিমারঘাটের ছায়াটা চকিতে ভেসে ওঠে চোখে। বহু দূর থেকে এক অচেনা রহস্যময় স্টিমারঘাট এগিয়ে আসে। ধু ধু বালিয়াড়িতে চাঁদের আলো পড়েছে। উঁচু থেকে দেখা যায় গড়ানো বালিয়াড়ির শেষে সেই জেটি, তারপর অনন্ত নিঃশব্দ জলরাশি-অথৈ। সেই স্রোতের ওপর আবহমান কাল ধরে ঝুঁকে আছে কালো আকাশ। ওইখানে সকলের দেখা হবে। সকলের সাথে দেখা হয়। একদিন মায়ের সাথে দেখা হবে।
( ৪২ বছর পর নদীটা দেখতে গিয়েছিলাম এবার। নদীর নাম পান্ডব নদী)
টরন্টো ২৯ অক্টোবর ২০২২

মন্তব্য করুন: