পুরুষ অধিকার খর্ব করে কি নারী অধিকার!
ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক করাকে ধর্ষণ বলা হয়। নারী যদি যৌনকর্মীও হয়, তারও অধিকার আছে নিরাপদভাবে বাঁচার। যৌনকর্মীরও ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য দিতে হবে, জোর করে স্পর্শও করা যাবে না। কথা আইনত সত্য, মানলাম। কিন্তু নারীবাদীর পরিচয়ধারী কিছু বুদ্ধিজীবী নারীর অধিকারের নামে গলাবাজি করলেও নারীর বেলেল্লাপনা নিয়ে এবং সিনেমা-নাটকে অবাধে নারীদেহের কুরুচিপূর্ণ প্রদর্শন নিয়ে তেমন কোনো কথা বলেন না।
সমাজের একটি শ্রেণি নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপন করলেও তাদের মাথাব্যথা নেই। অথচ অপসংস্কৃতি তথা সামাজিক অবক্ষয় নারী ধর্ষণের অন্যতম ও প্রধানতম কারণ হলেও শুধু পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বা পুরুষের রুচিবোধকেই দায়ী করা হয়। নারীর লোভাতুর প্রদর্শন পুরুষকে কাছে আসার আমন্ত্রণ জানাবে, কুমন্ত্রণা দেবে—এটাই স্বাভাবিক। বরং নারীর অবাধ আবেদনে পুরুষ স্রোতহীন নদীর মতো নিশ্চুপ হয়ে থাকবে—এটা ভাবা নিতান্তই নপুংসকীয় ধারণা। ফেনসিডিলও মেডিসিন; তাই বলে ড্রাগ যাবে না—তা তো ঠিক না। সবক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি শব্দটা বেমানান। কারণ পুরুষও মানুষ, ফেরেশতা নয়। ফেরেশতাও নপুংসক ব্যতিত কোনো প্রাণী জৈবিক চাহিদার ঊর্ধ্বে না। আমি পুরুষ, বেলাশেষে আমার পক্ষপাতিত্ব আমাকেই নিতে হবে—কথিত নারীবাদীদের ভুল-পাওয়ারের চশমা আমায় দেখবে না।
আজকের সমাজে ধর্ষণ একটি বিষফোঁড়া। বিকৃত মানসিকতার পুরুষ ধর্ষণ করে শরীর। আর বিকৃত মানসিকতার নারীও ধর্ষণ করেন পুরুষকে, তবে তা মানসিকভাবে। তাদের দ্বারা ধর্ষিত হয় পুরুষের বিশ্বাস, আস্থা, ভালোবাসা। তথাকথিত নারীবাদী সংগঠনগুলোর এসব বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই। দিনের আলোতে যারা নারীর অধিকার নিয়ে চিৎকার করেন, রাতের গভীরে রঙিন আলোর ফোয়ারায় তাদেরই কেউ কেউ নারীর দেহ নিয়ে উৎসবে মেতে থাকেন। শুধু নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতে করতে তারা বেমালুম ভুলে যান পুরুষ নামক প্রাণিরও (!) রয়েছে ন্যূনতম অধিকার। মূলত তাদের হাতেই বন্দি মানবাধিকার।
‘মানবাধিকার’ শব্দটি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য প্রযোজ্য হলেও একশ্রেণির মানুষের কাছে ‘মানবাধিকার মানে শুধু নারীর অধিকার’। নারী নির্যাতনের সংবাদ প্রতিদিনই ফলাও করে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়; কিন্তু পুরুষ নির্যাতনের সংবাদ হাজারে একটাও প্রকাশ হয় না। তাই বলে কি দেশে পুরুষ নির্যাতন নেই? আছে। আমাদের সমাজে ঘরে-বাইরে পুরুষরাও এখন হরহামেশা নির্যাতিত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশ পুরুষই মানসিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন, শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার হন কেউ কেউ। নারীর পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় সামাজিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন অনেকেই বছরের পর বছর। অথচ নারী নির্যাতনের ঘটনায় আমাদের সমাজ, আইন ও শাসনব্যবস্থা যে পরিমাণ সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেয়; নির্যাতিত পুরুষের বেলায় তুলনামূলক তার ১ শতাংশও নয়। ক্ষেত্রবিশেষ পুরুষরাই বেশি বৈষম্যের শিকার, ন্যায়বিচার বঞ্চিত, অনেকাংশে দেশের প্রচলিত বিচারব্যবস্থাও পুরুষের প্রতিপক্ষ। নির্যাতনের কথা বলাটাও যেন পুরুষদের জন্য মানা!
আমার এ লেখাটা নারী নির্যাতনকে উৎসাহিত করার জন্য নয়। কিংবা নারীসমাজকে অবমাননা করা, নারীর অধিকারকে অবজ্ঞা করা, নারী নির্যাতন দমন আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ বা অপ্রয়োজনীয় বলে সাব্যস্ত করাও উদ্দেশ্য নয়। নির্যাতন নির্যাতনই, তা নারী কিংবা পুরুষ বিবেচ্য নয়; বরং সব ধরনের নির্যাতনের প্রতিকার করাটাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমাদের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ নারী ও পুরুষ ভেদ না করে সকলের সমান অধিকারের কথা বলা আছে, কিন্তু বাস্তবে তা যেন চলছে উল্টো পথে। উপরন্তু সমঅধিকার, নারীর অধিকার বা নারীর ক্ষমতায়নের নামে নারীর অগ্রাধিকার সর্বত্র। ক্ষেত্রবিশেষ বঞ্চিত, শোষিত, হয়রানি করা হয় পুরুষকেই। দেশে নারী নির্যাতন দমন আইন আছে, কিন্তু নেই পুরুষ নির্যাতন দমন আইন।
সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদে নারীর অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নারী সুরক্ষায় রয়েছে বেশকিছু আইন। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০০ (সংশোধিত ২০০৩), যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০, এসিড নিরোধ আইন-২০০২, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০ অন্যতম। বস্তুত এসব আইন দেশের নারীর অধিকার কতটুকু প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে, এ প্রশ্নের চেয়ে আইনের অপব্যবহার কতটা হচ্ছে, তা-ই এখন ভাবার বিষয়। কেননা নারীর সুরক্ষার জন্য এসব আইন প্রণয়ন হলেও বর্তমানে কিছু নারী বা একশ্রেণির দুষ্টচক্র আইনগুলো পুরুষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
নির্যাতন যেরূপই হোক না কেনো; তা পরিবার, সমাজ বা ব্যক্তিজীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। নারীর প্রতি যেমন কোনো সহিংসতা চাই না; তেমনি পুরুষ নির্যাতনের শিকার হবে, আর কোনো প্রতিকার থাকবে না, এটাও কাম্য নয়। দু'টি পাতিল একসঙ্গে রাখলে টুংটাং শব্দ হয়; কারণবশত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও ছোটখাটো মনোমালিন্য বা সাংসারিক টানাপোড়েন থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। সামান্য পান থেকে চুন খসলেই বাবার পারিবারিক প্রভাব খাটিয়ে আইনের আশ্রয় নেন অনেক স্ত্রী। যৌতুকের মিথ্যা অভিযোগ এনে মামলা করে স্বামীদের বর্ণনাতীত ভোগান্তিতে রাখেন অনেকেই। স্বামী যৌতুক মামলায় জামিন বা খালাস পেলে পরে শারীরিক নির্যাতনের মামলা দেন। এতেও কাজ না হলে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে দেনমোহর বা ভরণ-পোষণের দাবিতে মামলা দিয়ে স্বামী বেচারাকে ‘শায়েস্তা’ করার সর্বশেষ চেষ্টাটুকু করতে ছাড়েন না অনেক নারী। স্বামীর উপার্জনের দিকে না তাকিয়ে অনেক নারীই নিজের ভোগ-বিলাসিতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন স্বামীদের। ‘পার্সোনালিটি’র নামে স্বেচ্ছাচারিতা করতেও পিছপা হন না কোনো কোনো স্ত্রী। স্বাধীনতা ভোগ করতে গিয়ে স্বামী-সংসারকে এখন অনেক নারীর কাছে ‘দাসত্ব’ মনে হয়।
সংসারে উপার্জন করাটা যেমন পুরুষের কর্তব্য, সংসার গোছানোটাও তেমনি নারীর দায়িত্ব, এটা মানতে চান না অনেকেই। ‘নিজের পায়ে দাঁড়ানোটাই নারীর অধিকার’, এমনই ধারণা তাদের। স্বামীর মা-বাবা, ভাই-বোন, তথা স্বজনদের সঙ্গে একত্রে না থাকা ও তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, মাত্রাতিরিক্ত আর্থিক চাহিদা, একাধিক ছেলেবন্ধু রাখা, বাইরে যাতায়াতে স্বামীর অনুমতির তোয়াক্কা না করা, এমনকি সন্তান প্রতিপালনে অনীহাও এখন ‘কালচার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব নীরবে মুখ বুজে সহ্য করেও বছরের পর বছর সংসার টিকিয়ে রাখার সর্বশেষ সাধ্যটুকু করে যাচ্ছেন হাজারো নিরীহ স্বামী। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার সংসার। আর মা-বাবার ভুলের মাশুল দিতে পরবর্তী প্রজন্মকে যুগের পর যুগ অভিশপ্ত জীবন বহন করতে হচ্ছে। অপসংস্কৃতি তথা ভিনদেশি সাংস্কৃতিক প্রবাহ আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে, সাংসারিক জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করছে, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ক্রমেই দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
বর্তমানে কিছু নারী দুষ্টচক্র বিয়ের নামে কাবিনের ব্যবসা করে নিরীহ পুরুষদের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে। অনেক সহজ-সরল নারী যেমন বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের শিকার হন, তেমনি প্রেমের ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন অনেক পুরুষ। কিছু কিছু বিবাহিতা বা মধ্যবয়সী নারীর বিকৃত রুচির পাল্লায় বখে যাচ্ছে উঠতি বয়সের অনেক যুবক। নারী ধর্ষণ যে হারে হচ্ছে, তুলনামূলক সে হারে না হলেও পুরুষ ধর্ষণ যে সমাজে নেই, তা কিন্তু নয়। তবে তা প্রকাশ করেন না কেউই। দেশে নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান থাকলেও পুরুষের অধিকার নিয়ে কাজ করার মতো কেউই নেই। মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় থাকলেও নেই পুরুষবিষয়ক কোনো মন্ত্রণালয়, অধিদফতর বা পরিদফতর।
সাম্প্রতিক সময়ে আত্মপ্রকাশ করা ‘বাংলাদেশ মেনস রাইটস ফাউন্ডেশন’ নামের সংগঠন এক জরিপে বলেছে, দেশে ৮০ ভাগ বিবাহিত পুরুষই নানাভাবে নির্যাতনের শিকার। বিশেষ করে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েও তারা তা বলতে পারেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লোকলজ্জার ভয়ে এবং সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে পুরুষেরা স্ত্রীর অনেক অন্যায় দাবি মেনে নিলেও সমাজে পুরুষ নির্যাতন কমেনি। প্রতিনিয়ত স্ত্রীর নির্যাতনের শিকার হলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না অনেক পুরুষ। ৯৯ শতাংশ পুরুষ সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, সামাজিক মর্যাদা বা লোকলজ্জা, মামলার ভয়ে বাধ্য হয়ে স্ত্রীর নির্যাতন নীরবে সহ্য করেও মানিয়ে নিচ্ছেন।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিভাগের ভাষ্যমতে, যৌতুকের ঘটনায় করা মারধরের ৯০ ভাগ মামলাই মিথ্যা। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিষয়টি নিয়ে একেবারে গা-ছাড়া। বরং মামলায় স্বামীপক্ষের কাছ থেকে উৎকোচের অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। অধিকাংশ মামলা বছরের পর বছর চলতে থাকায় বাদী-বিবাদী উভয়ের জীবন-যৌবন ও অর্থের অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তা সূর্যের মতো সত্য।
সবার জন্য মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে পুরুষ অধিকার বাস্তবায়ন জরুরি। এজন্য দেশে পুরুষবিষয়ক মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর গঠন ও পুরুষ নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো নষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দু-এক মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করাটাই যুক্তিযুক্ত। প্রতিটি মিথ্যা মামলার জন্য দৃষ্টান্তমূলক সাজা ও উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও করতে হবে। সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা ও পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার প্রতি কঠোর নীতি অবলম্বন করতে হবে রাষ্ট্রকে। বিভেদ নয়; নারী ও পুরুষ উভয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই দূর করতে হবে নারী-পুরুষের মধ্যকার লিঙ্গগত বৈষম্য। তবেই প্রতিষ্ঠিত হবে সত্যিকারের মানবাধিকার।
(লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক)
[email protected]
বিভি/এনএ
মন্তব্য করুন: