প্রকৃত ভালোবাসায় শেষ বলে কিছু নেই
প্রকৃত ভালোবাসা সিনেমাকেও হার মানায়। বয়স, স্থান, মানুষ, সংস্কৃতি, ধর্ম, বর্ণ, মানসিকতা অনুসারে এই ভালোবাসার নানা রূপ দেখা যায়। আর প্রকৃত ভালোবাসা সে তো আমৃত্যু বেঁচে থাকে।
এই আমৃত্যু ভালোবাসার রূপ কয়জনই বা দিতে পারছে! যদি সবাই আমৃত্যু ভালোবাসার রূপ দিতে পারতো, তাহলে এতদিনে কয়েক হাজার লোক পেয়ে যেত ইতিহাসের পাতায় স্থান। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। স্বার্থের কাছে বারে বারে হেরে যায় প্রকৃত ভালোবাসা।
এই তো সাম্প্রতিক সময়ের ভারতের অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলার শর্মার কথাই যদি বলি। বয়স ২৪ ঐন্দ্রিলার। তারপর ও ক্যানসারের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে গেছেন। জিতেছেন ও কয়েকবার। কিন্তু বিধাতার লিখে রাখা ভাগ্যের কি পরিবর্তন সম্ভব! শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারের সঙ্গে আর পেরে উঠেননি।অথচ,ঐন্দ্রিলার এই যুদ্ধে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যিনি পাশে ছিলেন তার প্রেমিক সব্যসাচী। আর কেউ ছিলেন না। তার নিকটতম আত্মীয়রাও পাশে থেকে সাহস দেয়নি। কিন্তু তার প্রেমিক তাকে গাছের ছায়ার মতো আগলে রেখেছেন। তার প্রেমিককে পাশে রেখেই ঐন্দ্রিলা দ্বিতীয়বার ক্যানসার জয় করেছেন। এবারও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ১৯ দিনের লড়াইয়েও পাশে ছিলেন তার প্রেমিক।
এই ভালোবাসা স্বার্থের হলে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে চলে যেতেন সব্যসাচী। কারণ, ক্যান্সার হলো মরণঘাতী রোগ। তাছাড়া ঐন্দ্রিলা যখন মরেই যাবে, তাকে পাবোই না যখন আর ভালোবেসে কি ই বা হবে। কিন্তু না! তার প্রেমিক পাবো না জেনেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পাশে ছিলেন।এই অকৃত্রিম ভালোবাসার সংজ্ঞা কে দিবে!
ঐন্দ্রিলা শর্মা নিজেই তো বলে ফেললেন, তিনি অসুস্থের জন্য শারীরিক কষ্ট পেলেও প্রেমিকার ভালোবাসার জন্য মানসিক কষ্টটা কখনও পান নি। সেই প্রেমিক ঐন্দ্রিলা যখন অসুস্থ থাকতো তখনও ঐন্দ্রিলাকে রাতে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন।
"ভালোবাসতে লাগে না কোনো কারণ, অকারণে ভালোবেসে ফেলে এই মন" এমনটাই যেন ঐন্দ্রিলার প্রেমিকার ভালোবাসায় প্রকাশ পেয়েছে।
আবার এই ভালোবাসা শুধু মানুষ কেন্দ্রীক নয়। যে কোনো কিছুর মায়াজালে পড়ে মানুষ যে কোনো কিছুকে ভালোবাসতে পারে। এই ভালোবাসায় কেউ জিতে যায়, কেউ হেরে যায়, কেউ লিখে যায় কবিতা, কেউ গেয়ে যায় গান। এটি এমন এক অনুভূতি, যার মায়ায় একবার পড়ে গেলে সব উজাড় করে দেওয়া যায়। ঠিক কবিগুরুর মতো—কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া/তোমার চরণে দিব হূদয় খুলিয়া। চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি/গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি। কিন্তু এই ভালোবাসা কি শুধু ব্যাক্তিকেন্দ্রিক? একদমই তা নয়। এই মায়াজাল তৈরি হতে পারে যে কোনো কিছুকে ঘিরে। পরিবারের প্রতি ভালোবাসা, মা-বাবাকে ভালোবাসা, প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা এবং ভালোবাসা। ভালোবাসা মানে না কোনো বাধা। তাই তো অনেক সময় প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখে প্রেমে পড়ে যাই, রাস্তার ধারে ক্ষুধার্ত কুকুরটার প্রতিও ভালোবাসা জন্মে যায়। আবার ঠিক ভয়ংকর কিছুর প্রতিও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। আকাশে কালো ঘন মেঘ, বজ পাতের শব্দ, শীতের শোঁ শোঁ বাতাস, আবার মাঝে মাঝে গরমের তীব্র তাপ।
মানুষ শুধু বয়সে বাঁচে না, মানুষ মূলত ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। আর এই ভালোবাসা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। বাস্তবে ভালোবাসা হবে নিখুঁত। প্রকৃত ভালোবাসায় মানে না পরিবারের বাঁধা, মানে না সমাজের বন্দী শিকল,মানে না নিজের দুর্বলতার কিছু।
দিন শেষে এটাই প্রকাশ পায়, সত্যিকারের ভালোবাসা কখনও হারিয়ে যায় না। হাজারো ঝগড়া বিবাদ হলে কখনও আলাদা হয় না। ভালোবাসলে প্রিয় মানুষের এলোমেলো চুলগুলো দেখলে মনে হয় আহারে কি অযত্নে পড়ে আছে একটা শুভ্র ফুল। ভালোবাসার মানুষের অগোছালো হয়ে থাকতে দেখলে ইচ্ছা করে তাকে গুছিয়ে দেই।
ইচ্ছে করে তাকে মনের মতো করে সাজিয়ে দেই। ভালোবাসার মানুষের চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে দেখলে বলতে ইচ্ছে করে তুমি ঠিক মতো ঘুমাও না তাই না? নিজের প্রতি এতো অবহেলা করলে হবে? একটু নিজের যত্ন নিতে শিখো,তোমার জন্য না হয়, অন্তত আমার জন্য হলেও তোমাকে নিজের যত্ন নিতে হবে। ভালোবাসায় কোনো চাওয়া পাওয়া থাকে না। যদি সত্যিকারের ভালোবাসা হয়। তাহলে দূর থেকে ও ভালোবাসা যায়।
ভালোবাসার মানুষকে অনুভব করা যায়। কিছু কিছু মানুষের ভালোবাসা এমনই,এরা কেউ কাউকে দেখেনি,স্পর্শ করেনি, হাতে হাত রেখে একসঙ্গে হাঁটেনি।কিন্তু তারপরে ও তাদের অনুভূতির কোনো কমতি নেই। তাদের ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। নেই কোনো ঝগড়াঝাঁটি। দিন শেষে তারা দুজনেই তাদের ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে অনেক বেশি সুখী। জোর করে মানিয়ে নেওয়ার নাম কখনও ভালোবাসা হতে পারে না। এটি হলো শুধু জীবন অতিবাহিত করা।
প্রসঙ্গত, আমি একদিন ফেনীর রেলওয়ে স্টেশনে গেলাম ঘুরতে।গিয়ে দেখি দুই প্রেমিক -প্রেমিকা আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দিয়ে রেললাইনে বসে আড্ডা দিচ্ছে। স্মৃতি স্বাক্ষর হিসেবে ছবি তুলছে। আরেকটি কাহিনি দেখলাম, দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা মিলে তাদের একজনের জন্মদিন পালন করছে রেললাইনের সঙ্গে খোলা আকাশের নিচে। এসব ছোট ছোট অনুভূতিগুলো কতই না সুন্দর! দিন শেষে এসব দুজনেই নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মিল খুঁজে নেয়। তারাই তো ভালোবেসে সফল হয়। আর এটাই পবিত্র ভালোবাসা।
যদি ইতিহাসের কালজয়ী কিছু ভালোবাসার স্বাক্ষর দেখে নিই তাহলে বুঝবো তাদের ভালোবাসা আর স্বার্থের জন্য ভালোবাসা কতটা পার্থক্য:
রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটঃ
নিঃসন্দেহে রোমিও এবং জুলিয়েটের প্রেমের আখ্যান দুনিয়ার অন্যতম বিখ্যাত প্রেম কাহিনী। যেন ভালোবাসার অপর নাম রোমিও-জুলিয়েট। বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজ লেখক উইলিয়াম শেকস্পিয়ার এর কালজয়ী ট্রাজেডি হলো রোমিও-জুলিয়েট। সারা বিশ্বে যুগ যুগ ধরে পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে এ বিয়োগান্তক প্রেম কাহিনী।
রোমিও আর জুলিয়েটের পরিবারের মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক ছিল। দুটি ভিন্ন পরিবারের পূর্ববর্তী রেষারেষি, বংশীয় অহংকার ভেদ করে দুজন তরুণ-তরুণী প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ে যায়। পরবর্তীতে পরিবারের শত বাঁধা উপেক্ষা করে নানা নাটকীয়তার মাঝে তারা বিয়ে করে। সবশেষে, দুই পরিবারের শত্রুতার জেরে এবং ভুলবোঝা-বুঝি জনিত কারণে বিষপানে আত্মহত্যা করে এই প্রেমিক যুগল। তাই পৃথিবীতে যখনই প্রেমের জন্য ত্যাগ- তিতিক্ষার কথা বলা হয়, সবার আগেই উঠে আসে এই তরুণ যুগলের নাম! তরুণ এ যুগলের ভালবাসার জন্য মৃত্যুবরণ আজো পৃথিবীর মানুষকে একই আবেগে নাড়া দেয়।
প্যারিস এবং হেলেনঃ
গ্রীক পুরাণের ফ্যাক্ট এবং ফিকশনের অপূর্ব এক সংমিশ্রন হল, গ্রীকলেখক কালজয়ী হোমারের জগতবিখ্যাত এপিক “ইলিয়াড।” নাম করা সেই যুদ্ধের নাম হল, ‘ট্রোজান ওয়্যার’। যে যুদ্ধে ধ্বংস হয়েছিল পুরো একটা শহর- ট্রয়! ইতিহাসে যা ‘হেলেন অব ট্রয়’ নামে বিখ্যাত। দেবরাজ জিউস এবং স্পার্টার রাজা টিন্ডারিউসের পত্নী লীডার মিলনের ফলে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হেলেনের জন্ম হয়। বিশ্বসাহিত্যে হেলেন সেরা সুন্দরীর আসনে অধিষ্ঠিত। স্পার্টার রাজা মেনিলাসের সঙ্গে হেলেনের বিয়ে হয়। ট্রয়ের ছোট রাজকুমার প্যারিস হেলেনের প্রেমে পাগল হয়ে অপহরণ করে তাঁর রাজ্যে নিয়ে এসেছিলেন। হেলেনকে উদ্ধারে মেনিলাসের ভাই অ্যাগামেমননের নেতৃত্বে বিরাট গ্রিক সেনাদল ট্রয়ের অভিমুখে যাত্রা করে। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে চলে এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ। যুদ্ধের এক পর্যায়ে গ্রিক সৈন্যরা ট্রয় রাজ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে ট্রয়নগর। আগুনে পুড়ে হাজার হাজার সৈন্য আর নিরীহ নাগরিক মারা যায়। গ্রীক বীর একিলিসও হেলেনের অন্যতম পাণিপ্রার্থী ছিলেন। তাই একিলিস ছুটে যায় হেলেনকে বাঁচানোর আশায়; কিন্তু প্যারিস তীর বিদ্ধ করে মেরে ফেলে একিলিসকে। পালিয়ে যায় হেলেন, জয়লাভ করে গ্রিকরা। কিন্তু যে হেলেনের জন্য এত কিছু তাকে মেনেলাউস কাছে পেয়েছিল কি না তা আজও অজানা। প্রেমের জন্য এত রক্তপাত আর ধ্বংস পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ,ফেনী সরকারি কলেজ।
বিভি/এনএ
মন্তব্য করুন: