হারুনের ভাতের হোটেল, তাপসের ভাতের গাড়ি

ভীষণ ক্ষুধার্ত আছি: উদরে, শারীরবৃত্ত ব্যেপে …অনুভূত হতে থাকে – প্রতিপলে – সর্বগ্রাসী ক্ষুধা …সকলেই চায়: বাড়ি, গাড়ী, টাকাকড়ি- কারো বা খ্যাতির লোভ আছে; আমার সামান্য দাবি: পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর- ভাত চাই-এই চাওয়া সরাসরি – ঠান্ডা বা গরম…দু’বেলা দু’মুঠো পেলে ছেড়ে দেবো অন্য সব দাবি!...অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি নেই যৌন ক্ষুধা…চাইনি তো নাভিনিম্নে পড়া শাড়ি, শাড়ির মালিক… …চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব-প্রধান নারী,... উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী…আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ। ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।
এগুলো কবি রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতার কয়েক লাইন। কবিতাটিতে ভাত, গাড়ি, বাড়িসহ আরো অনেক শব্দ ও কথা আছে। ডিবির হারুনের ভাতের হোটেল আলোচিত ছিল তার মেয়াদ বা ক্ষমতাকালেই। এখন সেখানে যোগ হলো তাপসের ভাতের গাড়ির কথা। তাপস মানে ঢাকা দক্ষিণের পলাতক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নুর তাপস। তার জন্য জন্য দুপুরে ভাত আনতে বরাদ্দ ছিল একটি গাড়ি, জ্বালানি খরচ ২৮ লাখ টাকা। তিনি চম্পট দেয়ার পর ফাঁস হয়েছে খবরটি। গদিনশীন থাকাকালে বনানীর বাসা থেকে শেখ ফজলে নূর তাপসের জন্য প্রতিদিন দুপুরে খাবার আনতে যেত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি গাড়ি (সেডান কার) । শুধু এ কাজের জন্য নিয়োজিত ছিল করপোরেশনের পরিবহন বিভাগের একজন ড্রাইভার। বনানী থেকে ফুলবাড়িয়ায় দক্ষিণ সিটির প্রধান কার্যালয় নগর ভবনে টিফিন বক্সে করে খাবার আনতে ওই গাড়ির জন্য দিনে ২০ লিটার অকটেন বরাদ্দ ছিল। এখন এক লিটার অকটেনের দাম ১২৫ টাকা।
সেই হিসাবে তাপসের বাসা থেকে দুপুরের খাবার আনার পেছনে দিনে ব্যয় হতো ২ হাজার ৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে গাড়ির পেছনে জ্বালানি বাবদ মাসে খরচ হতো ৫৫ হাজার টাকা, যা বছরে ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। তাপস ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন ৫১ মাস। সে হিসাবে শুধু দুপুরের খাবার আনার জন্য গাড়ির জ্বালানি বাবদ সিটি করপোরেশনের ব্যয় ২৮ লাখ ৫ হাজার টাকা। খাবারের ওই গাড়ির বাইরে তাপস নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য সিটি করপোরেশনের তিনটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। তাপসের দপ্তরের দুই ছাত্রলীগ ক্যাডার কর্মকর্তাকেও গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। তার ব্যক্তিগত একজন কর্মীরও করপোরেশনের গাড়ি বরাদ্দ ছিল।
কবি রফিক আজাদের কবিতার মতো তাপস কাউকে বলেননি, ভাত দে হারামজাদা। কোনো হারামজদাকে ভাতের গাড়ি দেয়ার কথাও বলতে হয়নি। হারামজাদারা মনিবের খেদমতে বলিয়ান ছিল নিজ গরজেই। তাদের চাহনিতে সব হয়ে গেছে ম্যাজিকের মতো। রাজপরিবার বলে কথা। তিনি চাইলে হেলিকপ্টারও নিতে পারতেন। কেন যে তিনি তার ভাত আনার জন্য হেলিকপ্টার চাননি, সেটাও প্রশ্ন। আওয়ামী লীগ আজ ক্ষমতায় না থাকায় তাপসের ভাতের গাড়ি ও দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্টিং হয়। চট করে আবার দেশে ঢুকতে পারলে তিনি এর মজা বুঝিয়ে দেবেন। একটাকেও ছাড়বেন না বলে জানিয়ে তো দিয়েছেনই তার ফুফু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ভাতের গাড়ির বিষয়টি আসলে কোনো নিউজের মধ্যেই পড়ে না। শুধু সিটি কর্পোরেশন নয়, সরকারী বেশিরভাগ গাড়ী অনুরূপ ব্যবহার হয়। বাসা থেকে বাচ্চার স্কুল হেঁটে গেলে ৬-৮ মিনিট লাগে। কিন্তু গাড়ী অফিসারকে নামিয়ে দিয়ে ১০-১২ কিলোমেটার দুরের অফিস হতে আবার বাসায় এসে বাচ্চার স্কুলের কাজে ব্যবহার হয়ে আসছে। শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র থাকার সময় গত সাড়ে চার বছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে বেশির ভাগ নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনাই ছিল মুখ্য। এগুলোও কোনো খবর ছিল না। ২০২২ সালের নভেম্বরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ‘সহকারী সচিব’ পদে মাসে নিয়োগ পাওয়া ধানমন্ডি থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবদুল্লাহ আসিফ ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পালিয়ে যাওয়ায় একটু আলোচনায় আসে তাপসের দলীয় নিয়োগের কথা। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বিভিন্ন পদে আবদুল্লাহর মতো অন্তত ২০০ জনের চাকরি হয়েছে দলীয় বিবেচনায়। এসব নিয়ে কেউ টু-শব্দও করেননি।
সিটি করপোরেশনের স্থায়ী আমানতের বড় অংশ নিজের ব্যাংক মধুমতিতে চলে গেছে, তাই বা ক’জন জানতেন? ২০২০ সালে মেয়র হওয়ার পর তিনি সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয় বাড়ানোর দিকে নজর দেন। আয় বাড়লেও উন্নয়নমূলক কাজে তার জোর ছিল না; বরং সিটি করপোরেশনের টাকা নিজের ব্যাংকে রাখতে মনোযোগী ছিলেন তিনি। শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র থাকাকালে নগর ভবন ও দক্ষিণ সিটির আঞ্চলিক কার্যালয়ে বসানো হয়েছে মধুমতি ব্যাংকের ছয়টি বুথও; যেখানে মানুষ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন সেবার বিপরীতে টাকা জমা দিতে পারে। এগুলোও বিতাড়িত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিয়নের ৪’শ কোটি টাকা নিয়ে চম্পট দেয়ার তুলনায় বেশি বড় খবর নয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: