সহকারী, প্রধান এসব ভুলে যান — সবাই শিক্ষক
লেখক: এম আমিনুল ইসলাম
বাংলায় লেখার অভ্যাস নেই বললেই চলে। ইংরেজি প্র্যাকটিস করি ২৬ বছর — ইউনিভার্সিটি থেকে আজ অবধি। জানিনা কতকুটুন ইংরেজি আমি সঠিকভাবে লিখতে পারি কিংবা পাঠক হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। এখন আবার এআই-এর রমরমা যুগে সবাই ইংরেজিতে বেশ পরিপক্ক, স্মার্ট। অবশ্য আমি আগের মতোই থাকতে চাই। হয়তো কখনো ইংরেজিতে মাস্টার হলেই এআইকে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বানাবো। আমি এআই-এর দাস হতে চাই না। যাহোক, এত বছরে আমার উপলব্ধি হলো বাংলাদেশে মায়ের ভাষা বাংলায় লেখালেখি বা যোগাযোগ আরো বেশি সহজ, জুতসই ও পাঠকপ্রিয়। চলুন, কাজেই আসল কথাই আসি।
গতকাল শনিবার, ৮ নভেম্বর, থেকে শিক্ষক আন্দোলন চলছে রাজধানী ঢাকায়। মিডিয়ার রিপোর্ট বলছে শনিবার বিকেলে ঢাকার শাহবাগে তিন দফা দাবিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে প্রাথমিক শিক্ষকদের মিছিলে চড়াও হয় পুলিশ। পুলিশের লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাসের শেল, জলকামান, সাউন্ড গ্রেনেডে শতাধিক শিক্ষক আহত হন। পুলিশি একশনের শিকার এই শিক্ষকেরা বর্তমানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন।
তথ্যনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫,৫৬৭। এসব বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ৬ লাখের বেশি। মোট শিক্ষক আছেন ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৬২৪ জন। এর মধ্যে সহকারী শিক্ষক আছেন প্রায় সাড়ে ৩ লাখ যাঁদের তিন দফা দাবিগুলোর অন্যতম হচ্ছে বর্তমানের জাতীয় বেতন কাঠামো বা স্কেলের ১৩তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীতকরণ, কেননা তাঁদের সতীর্থ প্রধান শিক্ষকরা এখন ১০ম গ্রেডে মাইনে পাচ্ছে। আগে হেড মাস্টাররাও ১১/১২ গ্রেডে মাইনে পেত। সহকারী শিক্ষকদের অন্য দুটি দাবি হলো, শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি এবং চাকরির ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড বা সিলেকশন গ্রেড দেওয়া।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হচ্ছে ১০ম গ্রেড। শিক্ষক মানে শ্রেফ শিক্ষক, শিক্ষক মানে সহকারী বা প্রধান নয়। স্কুলের সব শিক্ষক সহকর্মী। সহকারীরা প্রধানের চেয়ে কম ডিগ্রিধারী নন। কেউ কম যোগ্যতা নিয়ে শিক্ষক হননা। সহকারীরা কম পড়ান বা প্রধানরা বেশি পড়ান — এমন কিছু না। বরং সহকারীরা সকাল থেকে শুরু করে সারাদিন পড়ানোয় ব্যস্ত ও ন্যাস্ত থাকেন। এরা কলুর বলদ। তবে হ্যাঁ, প্রধান শিক্ষকদের চাকরি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই স্কুলে জয়েন করতে হয়, অফিসিয়াল কাজকর্ম ও শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকতে হয়। যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রধানরা দেরী করে অফিসে আসবেন, মাঝে মাঝে ক্লাসে ঢুকবেন আর অফিস চালাবেন। উপজেলায় কাজ থাকলে সেখানে যাবেন। অবশ্য, বাহিরে কাজ থাকলে সেজন্য যাতায়াত খরচও পান।
সহকারী শিক্ষিকদের যুক্তি হচ্ছে সব শিক্ষকদের একই গ্রেডে, অর্থাৎ ১০ম গ্রেডে মাইনে দিতে হবে। প্রয়োজনে মোটের উপর প্রধানদের মাইনে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বেশি হতে পারে বিশেষ ভাতা হিসেবে। তাঁদের এই যুক্তির সাথে আমিও একমত পোষণ করছি। আরেকটা বিধান যুক্ত করা যেতে পারে যে নতুন শিক্ষকরা, হোক সহকারী কিংবা প্রধান, শুরুতেই ১১তম বেতন গ্রেডে জয়েন করবে। ডিপিএড কোর্স সম্পূর্ণ হলেই কেবল তাঁরা ১০ম গ্রেড প্রাপ্ত হবেন। এতে করে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সব পক্ষই ঐকমতে পৌঁছবেন এবং সহকারী শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হবে।
এদিকে প্রধান শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণের কথা মাথায় রেখেই হয়তো শনিবার দুপুরে খুলনা শিল্পকলা একাডেমিতে ব্রিফিংকালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, "সহকারী শিক্ষকদের বর্তমান অবস্থান ১৩তম গ্রেড। প্রধান শিক্ষকদের আমরা সবেমাত্র ১০ম গ্রেডে উন্নীত করেছি, তাহলে সহকারীদের হঠাৎ করে ১৩তম গ্রেড থেকে কীভাবে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করব?"
দশম গ্রেড প্রসঙ্গে তিঁনি বলেন, "প্রাথমিক শিক্ষকদের একটা অংশ এই দাবিটা করে, বেশির ভাগ শিক্ষক মনে করেন, এই দাবিটা মোটেই যৌক্তিক না। আমরা পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রস্তাব করেছিলাম শতভাগ। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলেছে, সরকারের নীতি হচ্ছে এসব ক্ষেত্রে শতভাগ না দিয়ে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ দেওয়া, ২০ শতাংশ আমাদের রাখতে হবে নতুন নিয়োগের জন্য। ফলে ওনাদের পরামর্শ মোতাবেক সেটা করা হয়েছে। ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে যে টাইম স্কেল, সেটা বেতন কমিশন দেখবে, এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।"
মোদ্দা কথা হলো আমরা আমাদের দেশের সভ্যতা ও উন্নয়নের মূল কারিগর শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতে পারিনি কখনো। এক্ষেত্রে আমরা খুবই কৃপণ। অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শিক্ষকদের অর্থনৈতিক মান ও সুনাম দুটোই কেন জানি দুর্বল। ছাত্রছাত্রীরা ঠিকমতো পড়াশোনা করে না। ভালোভাবে উচ্চারণ করে পড়তে পারে না, যা অতিশয় আক্ষেপের বিষয়। অবশ্য যবে থেকে শাস্তি বা দণ্ডের বিধান বিলুপ্ত হয়েছে, তবে থেকে বাচ্চারা পড়ালেখাতেও মনোযোগী কম হয়েছে। ওরা পড়ার টেবিলমুখী না হয়ে ছোট স্ক্রিনের দিকেই বেশি মনোযোগী। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। এক্ষেত্রে, শিক্ষার কারিগর শিক্ষকদের যথাযত প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে তাঁদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ জরুরী হয়ে পড়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও ব্যক্তিবর্গের উচিত অযথা কালক্ষেপন না করে আন্দোলনকারীদের সাথে বৈঠকে বসে দাবি-দাওয়ার বিষয়ে কথা বলে তাঁদেরকে শ্রেণীকক্ষে ফেরত পাঠানো যাতে ছাত্রছাত্রীদের বার্ষিক পরীক্ষা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ছাত্রছাত্রীদের যেকোনো ক্ষতি তাদের ভবিষ্যতকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করবে।
লেখক: দুই দশকের বেশি বিভিন্ন জাতীয় ইংরেজি দৈনিকে সাংবাদিকতায় কর্মরত
ইমেইল: maislam.rose@gmail.com
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
বিভি/এজেড




মন্তব্য করুন: