• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫

৬ অক্টোবর বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি দিবস: ঐক্যের শক্তিতে সম্ভাবনার আলো

মো: মফিজুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:৪৫, ৬ অক্টোবর ২০২৫

আপডেট: ২৩:৪৬, ৬ অক্টোবর ২০২৫

ফন্ট সাইজ
৬ অক্টোবর বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি দিবস: ঐক্যের শক্তিতে সম্ভাবনার আলো

প্রতি বছর ৬ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি দিবস। এ দিনটি কেবল একটি প্রতীকী তারিখ নয়, বরং কোটি কোটি মানুষের প্রতি এক সম্মিলিত আহ্বান। সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত শিশুরাও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদেরও রয়েছে স্বপ্ন দেখার, শেখার ও পূর্ণাঙ্গ জীবনযাপনের অধিকার। বাংলার মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাস লিখেছিলেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। এই বাণী আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সক্ষমতা নয়, মানুষ হওয়াটাই মূল সত্য।

সেরিব্রাল পালসি: সমস্যা ও বাস্তবতা

সেরিব্রাল পালসি (Cerebral Palsy বা CP) হলো এক ধরনের স্নায়বিক বিকাশজনিত সমস্যা, যা শিশুর মস্তিষ্কে জন্মের আগে, জন্মের সময় বা জন্ম-পরবর্তী জটিলতার কারণে সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্কের যে অংশটি নড়াচড়া ও পেশী নিয়ন্ত্রণের কাজ করে, সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে শিশুর পেশী নিয়ন্ত্রণ, ভারসাম্য ও চলাফেরার স্বাভাবিক ক্ষমতা ব্যাহত হয়। কারও ক্ষেত্রে হাঁটতে অসুবিধা হয়, কারও হাত-পায়ের নড়াচড়া সীমিত হয়ে পড়ে, আবার কারও কথা বলার বা খাওয়ার দক্ষতাও প্রভাবিত হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি ১০০০ শিশুর মধ্যে গড়ে ২-৩ জন সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হয়। বৈশ্বিক গড়ে এই হার প্রতি ১০০০ জীবিত জন্মে ১ দশমিক ৫ থেকে ৪ জনের মধ্যে ওঠানামা করে। অপরিণত বা কম ওজনের নবজাতকের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত দেশগুলোতে প্রাক-প্রসব সেবা ও নবজাতক চিকিৎসার অগ্রগতির ফলে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের বেঁচে থাকার হার বেড়েছে। তবে, চিকিৎসা ও থেরাপির উন্নতির কারণে মোট আক্রান্তের হার কিছুটা কমেছে।

বাংলাদেশে সঠিক জাতীয় পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, দেশে বর্তমানে ৬ লাখেরও বেশি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হয়ে জীবনযাপন করছে এবং প্রতিবছর নতুন করে জন্ম নিচ্ছে প্রায় ১০-১২ হাজার শিশু। গ্রামীণ এলাকায় করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি ১০০০ শিশুর মধ্যে প্রায় ৩ দশমিক ৪ জন সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত, যা বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে কিছুটা বেশি। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়, বরং আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। যত দ্রুত সঠিক শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা যাবে, তত দ্রুত এই শিশুদের জীবনমান উন্নত করা সম্ভব।

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির চ্যালেঞ্জ:

পরিসংখ্যানের বাইরেও রয়েছে কঠিন বাস্তবতা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা। বাংলাদেশের অনেক পরিবার এখনও মনে করে প্রতিবন্ধীতা কোনো শাস্তি বা পূর্বজন্মের পাপের ফল। বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে কুসংস্কার, সামাজিক লজ্জা ও অবহেলার কারণে অনেক পরিবার চিকিৎসা বা থেরাপির উদ্যোগই নেন না। শহরে কিছু বিশেষায়িত সেবা থাকলেও গ্রামের অধিকাংশ শিশু রয়ে যাচ্ছে সেবাবঞ্চিত।

পরিসংখ্যান বলছে, সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত শিশুদের মাত্র ১০-১৫ শতাংশ নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ৯০ শতাংশেরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। একটি পরিবারের অভিজ্ঞতা এই বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে। কুমিল্লার এক কৃষক পরিবারের ছেলে সজীব জন্মের পর থেকেই হাত-পায়ের নড়াচড়ায় সমস্যা অনুভব করছিল। চিকিৎসক সেরিব্রাল পালসি শনাক্ত করলেও পরিবারটি প্রথমে ভেবেছিল এটি ‘নজর লাগা’ বা ‘পাপের শাস্তি’। তিন বছর বয়স পর্যন্ত চিকিৎসা শুরু হয়নি। পরবর্তীতে স্থানীয় এক এনজিওর সহায়তায় সজীব থেরাপি নিতে শুরু করলে ধীরে ধীরে বসতে ও হাঁটার দক্ষতা বাড়তে থাকে। সজীবের গল্প বলছে, সময়মতো সঠিক থেরাপি পেলে উন্নতি সম্ভব। কিন্তু, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক শিশু সেই সুযোগ হারাচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ: অগ্রগতি ও সীমাবদ্ধতা

বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করে, যেখানে সেরিব্রাল পালসিকে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ২০১৩ সালে শুরু হওয়া জাতীয় প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৩ জন সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন (এনডিডিএফ) এবং এনডিডি ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ, পুনর্বাসন ও আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থাও রয়েছে।

সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী কোটার ব্যবস্থা, কিছু বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চালু আছে। তবে, বাস্তবে এই নীতিমালার পূর্ণ প্রয়োগ এখনও সীমিত। প্রতিটি জেলায় থেরাপি সেন্টার নেই, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও থেরাপিস্টের ঘাটতি প্রকট এবং গ্রামীণ অঞ্চলে সেবার বিস্তৃতি অপ্রতুল। ফলে বেশিরভাগ পরিবারকেই ঢাকা বা বড় শহরে গিয়ে সেবা নিতে হয়, যা অর্থনৈতিকভাবে কষ্টকর।

সরকারের জন্য অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো:
১. জাতীয় পর্যায়ে সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত ব্যক্তিদের হালনাগাদ ডাটাবেইস তৈরি।
২. প্রতিটি জেলায় থেরাপি ও পুনর্বাসন সেন্টার স্থাপন।
৩. স্কুল, অফিস, গণপরিবহনসহ সর্বত্র প্রতিবন্ধীবান্ধব অবকাঠামো নিশ্চিত।
৪. শিক্ষক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ।
৫. অভিভাবকদের জন্য কাউন্সেলিং ও আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি চালু।

মূলধারার সমাজের দায়িত্ব:
কেবল সরকারের উদ্যোগই যথেষ্ট নয়; মূলধারার সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি করুণা নয়, প্রয়োজন সমান সুযোগ ও সম্মান।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: স্কুলগুলোতে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত শিশুদের জন্য সহায়ক বসার ব্যবস্থা, থেরাপি সহায়ক পরিবেশ এবং সহপাঠীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি।

গণমাধ্যম: টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে ইতিবাচক গল্প, সফলতার কাহিনি ও বাস্তব তথ্য প্রচার করতে হবে।

করপোরেট সেক্টর: কোম্পানিগুলোকে চাকরির সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহায়তা ও সামাজিক প্রচারণায় অংশ নিতে হবে।

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংগঠন: কুসংস্কার দূর করতে মানবিক বাণী প্রচার এবং সমাজকে সচেতন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

পেশাজীবীদের ভূমিকা:
দক্ষ পেশাজীবীরা সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত শিশুদের জীবনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনতে পারেন।

ফিজিওথেরাপিস্ট ও অকুপেশনাল থেরাপিস্ট: পেশী নিয়ন্ত্রণ ও দৈনন্দিন কাজের দক্ষতা উন্নত করেন।

স্পিচ থেরাপিস্ট: যোগাযোগ ও কথা বলার ক্ষমতা গড়ে তুলতে সহায়তা করেন।

মনোবিজ্ঞানী ও কাউন্সেলর: আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি ও পরিবারকে মানসিক সমর্থন দেন।

শিক্ষক: অন্তর্ভুক্তিমূলক পাঠদান ও অভিযোজিত শিক্ষাপদ্ধতি বাস্তবায়ন করেন।

কিন্তু, বাংলাদেশে এই পেশাজীবীদের সংখ্যা এখনও অপর্যাপ্ত। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে থেরাপিস্ট তৈরির প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে এবং দেশের প্রতিটি অঞ্চলে তাদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা:

দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে শেখার অনেক কিছু রয়েছে। ভারতে বৃহৎ পরিসরে কমিউনিটি বেইজড রিহ্যাবিলিটেশন (CBR) প্রোগ্রাম চালু রয়েছে, যা গ্রামীণ এলাকায় থেরাপি ও শিক্ষা পৌঁছে দিচ্ছে। শ্রীলঙ্কা সাধারণ স্কুলেই অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা বাস্তবায়ন করেছে। নেপালে এনজিওরা গ্রামীণ পর্যায়ে সক্রিয়ভাবে সেবা দিচ্ছে। এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এখনও মূলত এনজিওনির্ভর এবং কেন্দ্রভিত্তিক সেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই ব্যবধান ঘুচাতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বয় বাড়ানো জরুরি।

২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য: ভিন্নতায় সৌন্দর্য, একতায় শক্তি (Unique and United)

এবারের বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি দিবসের প্রতিপাদ্য- ‘ভিন্নতায় সৌন্দর্য, একতায় শক্তি’। অর্থাৎ, প্রতিটি মানুষই অনন্য। কিন্তু, ঐক্যবদ্ধ হলে সম্ভাবনার আলো আরও উজ্জ্বল হয়। প্রতিটি শিশুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে নতুন ভোরের স্বপ্ন। শুধু দরকার সমান সুযোগ, সঠিক সহায়তা এবং একসাথে এগিয়ে চলার মানসিকতা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিখ্যাত ‘প্রেম’ গীতিনাট্যে বলেছেন, ‘সবাইকে আপন করে, সকল প্রাণে মোর প্রেমের আলো জ্বালো’। এই চিরন্তন মানবিক বাণীই আমাদের পথপ্রদর্শক হোক। সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত শিশুদের জন্য প্রয়োজন করুণা নয়, প্রয়োজন অধিকার; প্রয়োজন এমন একটি সমাজ, যেখানে সরকার নীতি প্রণয়ন করবে, পেশাজীবীরা সেবা পৌঁছে দেবেন এবং মূলধারার সমাজ তাদের সমান মর্যাদায় গ্রহণ করবে।

শেষকথা:

একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়তে আজ আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক- প্রতিটি সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত শিশুই অনন্য, কিন্তু আমাদের ঐক্যই তাদের স্বপ্ন পূরণের আলো। ভিন্নতায় সৌন্দর্য, একতায় শক্তি হয়ে আমরা যদি একসাথে কাজ করি, তবে সেরিব্রাল পালসির মতো চ্যালেঞ্জও পরিণত হবে সম্ভাবনার নতুন ভোরে।

 

মো: মফিজুল ইসলাম
এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর
মুনফ্লাওয়ার অটিজম ফাউন্ডেশন

বিভি/পিএইচ

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2