• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

এরদোয়ানকে ঘিরে কেন এত স্নায়ু যুদ্ধ

আমিরুল মোমেনীন মানিক

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ১১ মে ২০২৩

আপডেট: ১৩:২৭, ১১ মে ২০২৩

ফন্ট সাইজ
এরদোয়ানকে ঘিরে কেন এত স্নায়ু যুদ্ধ

সারবিশ্বের বাম ও ইসলামপন্থীদের নতুন চোখ খুলে দিয়েছেন এরদোয়ান

১. প্র্যাগমাটিজম বলে একটা কথা আছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। প্রজ্ঞা, কৌশল এবং দূরদর্শিতার চূড়ান্ত সমন্বয়কে বলে প্র্যাগমাটিজম। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সফলতার মূল কারণ এই প্র্যাগমাটিজম। তুরস্কে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে এরদোয়ানকে নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে ব্যাপক হৈ চৈ চলছে। তবে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ ভিনদেশি এই নেতার প্রতি বিশেষভাবে সহানুভূতিশীল। এটা আমাদের জন্য আনন্দের এই কারণে যে, বাংলাদেশের মানুষ হয়েও আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনের খোঁজ রাখি। ধীরে ধীরে আমরা যে আন্তর্জাতিক মানুষে পরিণত হচ্ছি, এটা একটা নমুনা বটে। অবশ্য এটা শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। 

বিশ শতকের বিশের দশকে কামাল আতাতুর্কের উত্থানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম উচ্ছ্বাসের সঙ্গে লিখেছিলেন- ওই ক্ষেপেছে পাগলা মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই, কামাল তুনে কামাল কিয়া হ্যায়...। এরদোয়ানের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের এই যে ভালোবাসা, এটা নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের নি:স্বার্থ ভালোবাসার দারুণ প্রকাশ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মজার ব্যাপার হলো, এদেশের সরকার এবং বিরোধীপক্ষ উভয়ের সঙ্গেই এরদোয়ানের চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। 

এবার আসি এরদোয়ানের দর্শনে। ইউরোপের মস্তকে বসে এই যে এরদোয়ান নিজের ক্যারিশমা দেখাচ্ছেন, তা কেবল তার দূরদর্শিতা এবং কর্মকৌশলের কারণে।

২. তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতাকে মেনে নিয়েই রাজনীতি করছেন এরদোয়ান। কামালের ধর্মনিরেপক্ষতায় ছিলো, সব ধর্মকে নিরুৎসাহিত করা। আর এরদোয়ান দিলেন নতুন ব্যাখ্যা। তিনি বললেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে হলো সব ধর্ম পালনের অধিকার। ধর্ম পালন করলে যেমন বাধা দেয়া যাবে না, তেমনি না পালন করলেও বাধ্য করা যাবে না। এই আদর্শ একে পার্টিতেও প্রয়োগ করলেন তিনি। সেজন্য দেখা যায়, একে পার্টির অনেক মহিলা কর্মী হিজাবমুক্ত। এরদোয়ানের এ নীতির কারণে তুরস্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বাধাহীনভাবে ইসলাম পালনের সুযোগ পায়।

তাছাড়া, একে পার্টির সদস্য হওয়ার পূর্বশর্ত ইসলাম পালন করা নয়। সুশাসন ও সুবিচারের প্রতি আপোষহীন থাকাকেই এখানে প্রাধান্য দেয়া হয়।

৩. তুরস্কের প্রধান বাম সংগঠন সিএইচপি এবং প্রধান ইসলামী দল সাদেত পার্টির কাছে এরদোয়ান নিকৃষ্ট মানুষ। এরদোয়ান এমন মধ্যপন্থার আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে ন্যায্যতাই মূল কথা। তার দর্শন অনেকটা এরকম-ডানের বামে, বামের ডানে । এক্ষেত্রে, এরদোয়ান কোন পপুলার কনসেপ্টের আশ্রয় নেন নি। তিনি দেশের প্রয়োজনে যৌক্তিক একটি মডেল উপস্থাপন করেছেন, যেটা প্রচলিত বাম ও ইসলামী আন্দোলনের ধারণাকে ভেঙ্গে দিয়েছে। তিনি একটি সুদূরপ্রসারী ও প্রাজ্ঞ চিন্তার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তার একে পার্টির কর্মপন্থায়, ফলে হুযুগে নয়, জনগণ জাগরণে-মননে ধারণ করছেন একে পার্টির আদর্শকে। ফলে তিনি বারবার নির্বাচিত হচ্ছেন। আমাদের এই অঞ্চলে কোনো সেক্যুলার মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানও যদি কোনো নারীর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেন সেটা নিয়ে ইসলামপন্থীদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে যায়, কিন্তু এরদোয়ান এটা করেন সচেতনভাবেই। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলেছেন, এই দৃশ্য আমাদের দেশে ইসলামপন্থীদের কাছে অস্বাভাবিক, কিন্তু সেখানকার মানুষের কাছে এটাই সামাজিক ।

৪. ব্যর্থ সেনা অভুত্থানের পর এরদোয়ান আমেরিকাকে পাশ কাটিয়ে ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ককে পাকাপোক্ত করেছেন এরদোয়ান ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন নি কৌশলগত কারণে। ক. ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক একটি চুক্তির ভিত্তিতে হয়েছে, এর ফলে ফিলিস্তিনে ত্রাণ সরবরাহ সহজ করা । দুই. চুক্তি বাতিলের ভয় দেখিয়ে ইসরায়েলের উপর চাপ প্রয়োগের সুযোগ থাকা।

৫. এরদোয়ান ক্ষমতায় এসেই নিজের আদর্শের পক্ষে সংস্কার শুরু করেননি। কিন্তু মিসরের প্রেসিডেন্ট ড. মুরসি সালাফিদের চাপে এক বছরের মাথায় ইসলামী সংবিধান প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়েন। যেটি এরদোয়ান করেন নি। তিনি প্রথমে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন । পরে তিনি ধীরে ধীরে সংস্কার কাজে হাত দিয়েছেন । যেমন: এরদোয়ান এ্যালকোহল নিষিদ্ধ করেছেন সামাজিক কারণ দেখিয়ে, দৃশ্যত কোন ইসলামী অনুশাসনকে সামনে এনে নয়। এক্ষেত্রে এরদোয়ানের ব্যাখ্যা হলো: এ্যালকোহল মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে বিঘ্নিত করে, মদ্যপানের ফলে যথাসময়ে পেশাগত কাজ করা যায়না, সুতরাং সামাজিকভাবে এটাকে বয়কট করা উচিৎ। এই কনসেপ্ট তুরস্কের মানুষের কাছে পছন্দ হয়েছে।

তিনি ক্ষমতায় গিয়ে গণমাধ্যমের মুখ একতরফাভাবে বন্ধ করেননি। তিনি নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন থাকতে দিয়েছেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, এখনো তুরস্কে শক্তিশালী অনেক বিরোধী মতের গণমাধ্যম টিকে আছে এবং ভোট কারচুপি নিয়ে কোনো ধরনের সন্দেহ সংশয় উদ্বেগ নেই বিরোধীদলের মধ্যে। তবে ব্যর্থ অভ্যূত্থানের পর তিনি যে লৌহমানবের পরিচয় দিয়েছেন, সেটা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে বিরোধী মহলে ।

৬. শিল্প-সংস্কৃতি-চলচ্চিত্রে তিনি নিজের দর্শন প্রয়োগে যথেষ্ট সংযমী থেকেছেন। পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন প্রথমে। এরপর যৌক্তিক প্রয়োজনে সংস্কারকে সামনে এসেছেন। ফলে সেক্যুলার সমাজ খুব একটা বিরক্ত হননি এরদোয়ানের প্রতি। প্রচলিত ধারার বিপরীতে তিনি একটি সামাজিক-মানবিক ধারা তৈরী করতে শিল্পী অভিনেতাদেরকে উৎসাহিত করেছেন। সেজন্য তিনি ক্ষমতায় এসে বলেন নি, মিউজিক হারাম, সিনেমা হারাম। বরং মিউজিককে তিনি গ্রহণ করেছেন যৌক্তিক প্রয়োজনে ।

৭.সারবিশ্বের বাম ও ইসলামপন্থীদের নতুন চোখ খুলে দিয়েছেন এরদোয়ান। সুতরাং আসুন এরদোয়ানের প্রশংসা করি তার দর্শনকে জেনে বুঝে। নইলে ভালোবাসার ফানুস নিমিষেই চুপসে যাবে । ২০১৬ সালে, বামদল সিএইচপির আমন্ত্রণে সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির গিয়েছিলেন তুরস্কে। সিএইচপির ইচ্ছা হলো, সুবিধাজনক সময়ে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে একটি গণআদালত প্রতিষ্ঠার । বাংলাদেশের গণআদালত সফল হবার ধারণাটি পেশ করতেই সেখানে যান শাহরিয়ার কবির। এই তথ্য সেখানকার গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ছিলো। কিন্তু এরদোয়ান সরকার এসব ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সহনশীলতাই দেখায়। রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়েও তীব্র অসন্তোষ জানিয়েছেন। আবার রোহিঙ্গা সংকটের পর তিনিই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শ্রেষ্ঠ মানবিক মানুষ বলেছেন ।

৮. আমি বাংলাদেশের একজন ক্ষুদ্র গণমাধ্যম ও সংস্কৃতিকর্মী। আমি প্র্যাগমাটিজমকে পছন্দ করি। যে কোন ইতিবাচক পরিবর্তন বা চিন্তাকে আমি স্বাগত জানাই অন্তর থেকে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

বিভি/রিসি

মন্তব্য করুন: