কিংবদন্তি রাজনীতিক সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুবার্ষিকী আজ
সাদেক হোসেন খোকা (ফাইল ছবি)
রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, কিংবদন্তি রাজনীতিক, খ্যাতিমান ক্রীড়া সংগঠক, সাবেক মন্ত্রী, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (৪ নভেম্বর)। দল-মতের উর্ধ্বে জনকল্যাণে কাজ করা এই কালজয়ীকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছেন দেশের অগণিত মানুষ। জনতার ভালোবাসা নিয়ে জীবন ত্যাগ করা এই ‘হিরো’র জীবনের কিছুটা অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকের জন্য।
একাত্তরের অক্টোবর। ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের একের পর এক আক্রমনে দিশেহারা পাকিস্তানি বাহিনী। কিন্তু, এখানকার জনজীবন পুরোপুরি স্বাভাবিক প্রমাণে পাকিস্তানিরা তথ্যচিত্র বানিয়ে প্রচার চালায় দেশে-বিদেশে। জঘন্য সেই মিথ্যাচার রুখে দিতে গেরিলা যোদ্ধাদের একটি গ্রুপ উড়িয়ে দেয় তথ্য অধিদপ্তর কার্যালয়। দুঃসাহসিক সেই গ্রুপটির নেতৃত্বে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা। গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন হয় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন অফিসে। বিমান বাহিনীর রিক্রুর্টিং অফিস আর পিলখানার গেটেও সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে হয় দুঃসাহসিক অভিযান।
৭১-এ সাদেক হোসেন খোকা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন মাকে, এমনকি পরিবারের অন্য কাউকে কিছু না জানিয়ে। ভারতের আগরতলায় যুদ্ধের ট্রেনিং নেন কর্নেল খালেদ মোশররফের নেতৃত্বাধীন দুই নম্বর সেক্টরে। প্রশিক্ষণ শেষে মেজর হায়দারে নেতৃত্বে কুমিল্লার সালদা নদী ও মন্দবাগ এলাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেন সাদেক হোসেন খোকা। পরে তাঁকে কমান্ডারের দায়িত্ব দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়।
সাদেক হোসেন খোকা ১৯৬৮-৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনে তরুণ-যুবকদের মধ্যে সাদেক হোসেন খোকা ছিলেন অগ্রভাগে। ১৯৭৭ সালে বিপুল ভোটে ঢাকা পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন তিনি। নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও প্রথম সারিতে ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা।
নয় বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৯১ এর নির্বাচনে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হারিয়ে টক অব দ্য কান্ট্রিতে চলে আসে তার অবস্থান। নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পান যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের।
১৯৯৬ সালে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাদেক হোসেন খোকা আবারও নির্বাচিত হন। এরপর তিনি ঢাকা মহানগর বিএনপির আহবায়কের দায়িত্ব পান। তাঁর নেতৃত্বে পরের পাঁচ বছর সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঢাকায় রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। একটি প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে রক্তাক্ত হয়েও রাজপথ ছাড়েননি তিনি।
২০০১ সালে চতুর্থ বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মৎস ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন সাদেক হোসেন খোকা।
২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। নিরলসভাবে কাজ করে সাদেক হোসেন খোকা নগর পরিসেবায় নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
সম্পূর্ণ বেসরকারি অর্থায়নে নির্মিত গুলিস্তান যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভারে শুধু উদ্যোগ গ্রহণই নয় নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছিলো তার সময়ে।
খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিদের নামে বহু সড়ক ও স্থাপনার নামকরণ করেন সাদেক হোসেন খোকা।
বাংলাদেশের গর্ব, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নগরবাসীর পক্ষ থেকে বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল সাদেক হোসেন খোকার উদ্যোগেই।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা এই নেতা ছিলেন কর্মীবান্ধব। সুখে দুঃখে নেতা-কর্মীদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন সবার আগে। বাংলার এই বীরকে ভৌগলিক সীমানার বাইরে যুক্তরাষ্ট্রে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে হয় ২০১৯ সালের এই দিনে।
রণাঙ্গনের এই বীর যোদ্ধার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সমাপ্তি হলেও, সময়ের বিবর্তনে সাদেক হোসেন খোকা আজও আছেন মানুষের ভাবনায়-ভালোবাসায়।
বিভি/পিএইচ
মন্তব্য করুন: