সদ্যপ্রয়াত শাফিন খানকে নিয়ে স্মৃতিচারণ
মুঠোফোনের ভালোবাসা

বাংলাভিশনের প্রয়াত ন্যাশনাল ডেস্ক ইনচার্জ শাফিন খান।
হাসপাতাল থেকে ফিরে কাজ করছি ডেক্সটপে। ওখানে ৪ জনের লাশ। স্বজন হারাবার বেদনা আর আহাজারিতে চত্বরটা ভারি হয়েছে খুব। মানুষগুলোর চলাচলে আকাশ-পাতালও ভারি। ঘটনা দিনাজপুরের কিন্তু ঠাকুরগাঁওয়ের কাছে। সড়ক দূর্ঘটনা। একটু পরেই শাফিন ভাইকে ফোন করবো। ভালোবেসে বলবেন উনি, ডাবলু ভাই! বলবো ভাই, মানুষগুলো সব ঠাকুরগাঁওয়ের। ট্রেনিং-এ যাচ্ছিল প্রাইভেট গাড়িতে। পথিমধ্যে ট্রাকের ধাক্কায় এই অবস্থা।
ফুটেজ কাটাকাটির পর মেইলে জোড়া লাগাতে দিয়ে ফেসবুকে চোখবুলাবো ভেবে ক্লিক করতেই আমাদের নিউজরুমের সিনিয়র সূচিদির পোষ্ট ভেসে আসলো। কিন্তু পোষ্টটা আনমনে রেখে উপরে টানছিতো..... টানছিই। কিছুক্ষণ পর। কি যেন লিখেছে সূচিদি! শাফিন ভাই সম্পর্কে লেখা দেখলাম মনেহয়। দেখিতো। দেখলাম! শাফিন ভাই......? এ কেমন পোষ্ট !
কিছুক্ষণ ..... যেন সবকিছু ব্লকড। আমার কম্পিউটারের পর্দায় কালো জমিনে সাদা লেখার দিকে তাকিয়ে আমি। ভাবনায়, ওনার অফিসে আসার সময় হলো যে। এতক্ষনে এসেছেন বধয়। আমিযে একটু পরেই ফোন করবো! শুনবো জী ডাবলু ভাই বলেন। সূচিদি কি লিখেছেন এসব? রাগ করে নাতো আবার। একটু পরে আবার মনে হলো, এতো বোকা আমি-এতো কালো জমিনে সাদা লেখা। তার মানে? শাফিন ভাই....... ? বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে ফোন করলাম দিদিকে। আশা করছিলাম আমাকে আবারও পোষ্টটা পড়তে হবে। সূচিদি বলবেন, ভালো করে পরেন ভাই! কি দেখতে কি দেখেছেন। কিন্তু না। ফোনের ওপারে এক ধরনের অস্থিরতার শব্দ। গোটা অফিস জুড়ে। সূচিদি ফোন রিসিভ করলেন বটে কিন্তু কথা বলতে পারছেন না। শুধু বললেন ঘটনা সত্য, পরে ফোন করবো। আর একটা শব্দ। স্ট্রোক। বুঝলাম ফোন রেখে ব্যাস্ত হয়ে পরলেন। আবারও ফোন। এবার জুয়েল ভাই। আমাদের বিভাগীয় চিফ। প্রশ্ন করার আগেই বললেন শাফিন ভাই আর নেই। এই হলো শাফিন ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ আমার কাছে।
কিছুক্ষণ টেবিলে মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকা। কোথায় যেন। একদৃষ্টে। কিছুক্ষণ পর সুলতানার সাথে শেয়ার। শরীর আর চাপ সহ্য করলো না। বাঁধটা ভেঙ্গে গেলো। মনে হলো কোথা থেকে আসে এত জল। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কান্না। কিভাবে আপন কেউ না হয়ে এত আপন হতে পারে মানুষ। স্বার্থের এই দুনিয়াতে এত নিস্বার্থ ভালোবাসা। শাফিন ভাইয়ের একটু আগপাছ থেকে আমিও বাংলাভিশনে। বছরে একদুইবার দেখা হওয়ায় কি এত ভালোবাসা ? এত শ্রদ্ধা মানুষটার প্রতি। নিইজ ডেক্সে গেলেতো একটু ভয়, লজ্জা আর সংকোচ থাকে। হাজার হোক উনারা আমার বস। কিন্তু অফিস আর শাফিন ভাইয়ের অন্য রকম স্নেহ আমাদের জেলা প্রতিনিধিদের প্রতি। প্রয়োজনীয় কথা আর আড্ডা শেষে ওঠার সময় বলতেন, এই আপনার জন্য দুপুরের খাবার ওর্ডার করেছি। বলতাম, কেন ? অফিস আদেশ নাকি? নাকি মন কিনছেন? সাথে সাথে লম্বা একটা হাসি। যদি সময় থাকতো খেয়ে আসতাম। কতদিন খেয়েছি। বলতেন উনি। কারণ উনি যে চার্জে আছেন। উনার সাথেই যে আমাদের কথা হয় খুব। আমাদের বাংলাভিশনের নিউজরুম যেন প্রতিনিধি বান্ধব। আর শাফিন ভাই! মনে হলো, বাংলাভিশনে আমার একটা অপ্রত্যাশিত স্মৃতির কথা।
একটা খবরের কথা- শাফিন ভাই বললেন, ডাবলু ভাই, খবরটা কি নিজে পাঠিয়েছেন? বললাম না ভাই। বললেন, যাকে দিয়ে পাঠিয়েছেন তাকে কষে একটা থাপ্পর মারেন। পরে বলছি। ভাই থাপ্পর মারাতো যায় না আমি একটু সমস্যায় আছি। উনি বললেন, ভাগ্যিস ডেক্সে আমি আর নাসরিন আছি। আপনার সেই দিনের সেই মহানুভবতা আমি কেমনে ভুলি শাফিন ভাই! আমার উপর কোন রাগ, ক্ষোভ, আর অফিসিয়াল পদক্ষেপ না নিয়ে আমাকে শুধু ভালোবাসাই দিয়ে গেলেন। ক্ষমা, স্নেহ,ভালোবাসা, মহানুভবতা এই শব্দগুলোই যেন শাফিন ভাই। জেলা প্রতিনিধিদের কিভাবে আপন করে নিতে হয়, তা তিনি করেছেন মন থেকে, তৈরী থেকে নয়। একজন ভালো অভিভাবকের প্রথম পরীক্ষায় উনি আমাদের কাছে সর্বোচ্চ নাম্বার পাওয়া একজন অবিভাবক। শাফিন ভাই দোয়া করি আপনার জন্য, আল্লাহ আপনাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ আসনে আসিন করুন।
গতবছর একটা ফোন রিসিভ করে উনি বললেন, ভাই আমিতো খুলনায়। আমার ভাই মারা গেছে। কাজটা কেয়ার হাতে। খোঁজ নেন। তখনও তাঁর কন্ঠে ছিল না কোন বিরক্তির ছাপ। একদিকে তাঁর মনে শোকের ছায়া অথচ কি স্বাভাবিক উত্তর তাঁর। নিজেকে তখন খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। আজকের দিনেও তাঁকে ছড়িনি আমি। প্যাকেজের খোঁজ যেন নিতেই হবে আমাকে! ফোন কখনও সময় বুঝে করিনি ওনাকে আমি। কি ডে কি অফডে। কি সকাল কি গভীর রাত। কি সুখে আর কি দুখে। যখন মনে হয়েছে। কি রকম মানুষ আমি, আমি নিজেও জানিনা। হয়ত নিজেকে আপগ্রেট করবার জন্য। খবরের খবর নেবার জন্য। এলাকায় নিজেকে জাহির করবার জন্য।
একদিন কি একটা খবরের জন্য সূচিদির সাথে কথা হচ্ছিল। কিন্তু দরকার ছিল শফিন ভাইয়ের। শাফিন ভাইয়ের নাম বলাতে সূচিদি বললেন, আজকে উনার অফডে আজকে বিরক্ত করার দরকার নাই। কথাটা নাজনিন আপুও একদিন বলেছিলেন। সূচিদি আর নাজনিন আপু বুঝেছিলেন মানুষটা এত চাপ সহ্য করে। আমি বুঝিনি। সূচিদি না বললে আমি হয়ত ফোন করতাম। কারণ উনার বিরক্তিতো দেখিনি কোন দিন। তারপর হয়ত উনি বলতেন, আগামী পরশু অন এয়ার হবে মনে হয়। সিরিয়ালে আছে। এখন খুব মনে হচ্ছে শাফিন ভাই কবে থেকে আপনি আমাদের ছেড়ে যাবার সিরিয়ালে ছিলেন। আর কবে যে কার সিরিয়াল শুরু হবে।
‘বাংলাভিশন নিউজ ডেক্স’ এই বাক্যটা শাফিন ভাইয়ের গলায় আর শোনা হবেনা আমার। কেন যেন একটু ভিন্নরকমের। একটু ভিন্ন রকমের ভালোবাসার। কতদিন ভেবেছি, শাফিন ভাইকে বলবো, তাঁর ভিন্ন রকমের ভালোবাসার কথা। আর বলা হলো না তাঁকে। শাফিন ভাই, নিশ্চয়ই ভালো থাকবেন ওপারে। আপনার অগনিত ভক্তের দোয়া যে আপনার সাথে। আপনি আমাদের কাছে শুধু শিক্ষকই নন একজন অভিভাবকও। একটা প্রতিষ্ঠানকে জনপ্রিয় করবার জন্য আর সবার সাথে আপনারও যে প্রচেষ্টা তা আমাদের কাছে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে অনুপ্রেরণার নিদর্শন হয়ে থাকবে চিরদিন।
ডেক্স ইনচার্জ শিপনদাকে বেশীদিন পাইনি আমি। আর তার সাথে তেমন সম্পর্কও ছিলনা আমার। কিন্তু শাফিন ভাই ! তাঁর কাছে অন্যরকম স্নেহের জগতে বসবাস ছিল আমার। বিএনপি মহাসচিব, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে এলে সবসময় বিশেষ এলার্ট থাকতাম আমরা। মানে ঠাকুরগাঁওয়ের সংবাদ কর্মীরা। থাকতাম প্রতিযোগিতায়। অনেকদিন গেছে চলমান সংবাদ বুলেটিনে সংযুক্ত হতে পারিনি। ডেক্স থেকে ফোন আসে বার বার। কতদূর হলো। কিন্তু ফুটেজ সংগ্রহ থেকে শুরু করে, নিউজ বানানো পর্যন্ত অনেক কাজ। দিচ্ছি আপু। দিচ্ছি ভাই। নিউজ ধরার চেষ্টা করছি ইত্যাদি। শাফিন ভাই একদিন মিষ্টি করে বললেন, ডাবলু ভাই, আপনার কাজে চাপ হচ্ছে বুঝি কিন্তু এ জন্য আমরাও একটু চাপে থাকি কর্তৃপক্ষের কাছে। শাফিন ভাই, আমার প্রতি আপনার কাজ আদায়ের ভালোবাসা কেমনে ভুলি বলেনতো। জেলার সংবাদ কর্মীদের প্রতি আপনার স্নেহ, মমতা আর ভালোবাসা কাজের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হয়ে আছে আমাদের।
আর আবদারের কথা বলি, কোন কোন নিউজ করতে দেরি হয় আমাদের অথবা আমাদের কাছে প্রত্যাশা করে এলাকাবাসি। আর আমরাও ডেক্সে ফোন করি। নিরাশ হইনি কোনদিন। কারণ জানলাম নিশান ভাইয়ের কাছে। তিনি বললেন, শাফিন ভাই আমাকে কতদিন বলেছেন, জেলা প্রতিনিধিরা নিউজ সংগ্রহে কত কষ্ট করে। নাহয় একটু ওলটপালট হয়েছে। দেখেনতো নিউজটা ঠিকঠাক করে অন এয়ার করানো যায় নাকি। এবং করিয়েছেন। এযেন ভালোবাসার বিনিময়। একে অপরের প্রতি কাজের সম্মান জানানোর বিনিময়। আমরা সম্মানিত হয়েছি শাফিন ভাই। আপনার স্নেহ আমাদেরকে সম্মানিত করার অভিপ্রায়ে। আজ যেন অসংখ্য কথা স্মৃতি হয়ে আছে আমার কাছে। নিশ্চয়ই আপনি ওপারে ভালো থাকবেন। আমাদের ভালোবাসা আছে যে আপনার সাথে।
একজন সংবাদ কর্মী হিসেবে আমি আজ সম্মানিত বোধ করি। কারণ যেই সংবাদ কর্মীদের সহচার্যে আমি সংবাদ কর্মীর খাতায় নাম লিখিয়েছি তাতে আমি সম্মানিত হয়েছি। বাংলাভিশনের অন এয়ারে আসার কাছাকাছি সময় থেকে আমি বাংলাভিশনের জেলা প্রতিনিধি হলেও শাফিন ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে খুব বেশী না। হয়ত বছরে দুএক বার। তবে কথা হয়েছে অনেক বেশী। ফোনে। মুঠো ফোনে । তাই আমি এই লেখার নাম দিয়েছি মুঠোফোনের ভালোবাসা।
আজ এই দিনে সৃষ্টিকর্তা তাঁর সম্মানিত আসনে আসিন করুন আপনাকে এই দোয়া করি শাফিন ভাই। আর সাথে সাথে আরো দোয়া করি, তিনি যেন আপনার পরিবারকে শোক সহ্য করার ক্ষমতা দান করেন।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: