• NEWS PORTAL

  • রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫

আজন্ম বিপ্লবী- ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

ইভা আক্তার

প্রকাশিত: ২০:১৬, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫

ফন্ট সাইজ
আজন্ম বিপ্লবী- ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

আজ ২৭ ডিসেম্বর। ক্যালেন্ডারের পাতায় একটি সাধারণ দিন মনে হলেও, বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য আর অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাসে এটি এক মহাজাগরণী ক্ষণ। আজ থেকে ঠিক ৮৪ বছর আগে এই দিনে জন্মেছিলেন সেই মানুষটি, যিনি শিখিয়েছিলেন- বিপ্লব মানে কেবল বন্দুকের গর্জন নয়, বিপ্লব মানে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় সস্তায় ওষুধ পৌঁছে দেওয়া, বিপ্লব মানে নারীর হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল তুলে দেওয়া। আজ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ৮৪তম জন্মদিন।

​সাভারের গণস্বাস্থ্যের এক নিশ্চুপ আমতলায় শুয়ে আছেন সেই মানুষটি। চারপাশে নেই রাষ্ট্রীয় আয়োজন, নেই বন্দুকের স্যালুট, নেই ক্ষমতার উচ্চকণ্ঠ শোক। অথচ মানুষের উপস্থিতিতে জায়গাটি ভারী হয়ে আছে। নীরবতা এখানে শূন্যতা নয়, এটি শ্রদ্ধার নিঃশ্বাস। এটি বলে, যিনি শুয়ে আছেন, তিনি ক্ষমতার খোলস বা নামের পেছনে লুকানো মানুষ নন। তিনি ছিলেন মানুষের পাশে দাঁড়ানো অকৃত্রিম বন্ধু।

ক্ষমতার আসনে কখনো তিনি বসেননি। রাজদরবারের ঘনিষ্ঠতাও কখনো তাঁর লক্ষ্য ছিল না। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিফলিত হয়েছিল মানুষের জন্য অকৃত্রিম দায়বোধ। মানবতার এই দর্শন তাঁর জীবনের মূল নীতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল: দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে না পারলে দেশে থেকে লাভ কী!

১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার কোয়েপাড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া শিশুটি ছোটবেলা থেকেই অন্যায়ের সামনে নীরব থাকতে পারেননি। বাবা হুমায়ন চৌধুরী ও মা হাসনা হেনা চৌধুরীর দশ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে বড় হতে হতে দায়িত্ব ও প্রতিবাদের স্বভাব তাঁর চরিত্রে মিশে গিয়েছিল। ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশন এবং ঢাকা কলেজে পড়াশোনা শেষ করার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, চিকিৎসা তাঁর কাছে কেবল পেশা নয়। এটি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক সরল ও শক্তিশালী উপায়।

১৯৬৪ সালে এমবিবিএস পাশ করে যুক্তরাজ্যে উচ্চতর চিকিৎসা শিক্ষায় নিযুক্ত ছিলেন। সেখানে নিশ্চিত ভবিষ্যৎ, সামাজিক মর্যাদা ও পেশাগত সাফল্যের প্রতিশ্রুতি ছিল তাঁর সামনে। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আকাশে আগুন জ্বলে ওঠার সময় তিনি বিলাসিতার পথ পরিত্যাগ করে মাতৃভূমির কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। পরীক্ষার কাগজের ভাঁজে ছিল না জাতির সুরক্ষা ও স্বাধীনতার প্রশ্ন। পাকিস্তানি নাগরিকত্ব থেকে নিজেকে আলাদা করে ভারতীয় ভিসা নিয়ে যাত্রা শুরু করেন যুদ্ধের পথে।

দামাস্কাস বিমানবন্দরে দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টার অপেক্ষা, পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের উপস্থিতি সব জানলেও তিনি পিছু হটেননি। কারণ ভয়ের কাছে আত্মসমর্পণ লড়াইকে শূন্যে মিলিয়ে দেয়। রণাঙ্গনে গিয়ে দেখেছিলেন যুদ্ধের অন্য মুখ—বন্দুকের শব্দের বাইরে যে যুদ্ধ আছে, তা আহত মানুষের ক্ষত ও চোখের ভাষা দেখেই উপলব্ধি করলেন। গাছের ছায়ায় শুয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের আর্তনাদ তাঁকে শিখিয়েছে, জীবন বাঁচানোও যুদ্ধ জয়ের অংশ।

এই উপলব্ধি থেকেই গড়ে ওঠে ৪৮০ শয্যার বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। অস্থায়ী কাঠামো, সীমিত সরঞ্জাম, অদম্য সংকটের মধ্যেও সেখানে চলছিল চিকিৎসা। বীর প্রতীক সেতারা বেগমসহ অসংখ্য নারী কেবল সহকারী ছিলেন না, ছিলেন সংগ্রামের অংশ। যুদ্ধের অগ্নিপরীক্ষায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দৃঢ়তা তাঁর জীবনে নতুন কিছু ছিল না, বরং পূর্বনির্ধারিত এক মানবিক নিয়তির প্রকাশ।

স্বাধীনতার পর ক্ষমতার পথ তাঁর সামনে খুলে গেলেও আমলাতন্ত্রের গতি, দুর্নীতির দেয়াল ও রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা তাঁকে আহত করেছিল। একসময় নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন, দেশের মানুষের জন্য কাজ না করলে দেশে থাকার মানে কী। এই প্রশ্নের উত্তরেই তিনি তৈরি করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি না হলে বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমবে না—এটাই ছিল তাঁর নীতি।

লুঙ্গি ও খাদি শার্টে মিশে যান সাধারণ মানুষের ভিড়ে। বিলাসিতা কখনো তাঁর কাছে প্রয়োজন ছিল না। সত্যিকারের প্রতিভা কোনো স্যুট বা বাহ্যিক সাজে লুকানো থাকে না—নিজ হাতে কাজের পোশাক জুটিয়ে তিনি জীবনের সঙ্গে মানুষের সংযোগের এক অদম্য নিদর্শন তৈরি করেছেন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র শুধু হাসপাতাল ছিল না, এটি সমাজ গড়ার এক নীরব পাঠশালা। নারীর মুক্তি ছাড়া সমাজ এগোতে পারে না—এই বিশ্বাসকে তিনি বাস্তবে রূপ দেন। সাভারে নারীরা হয়ে উঠেছিলেন স্বাস্থ্যকর্মী, কারিগরি শ্রমিক, বয়লার অপারেটর এবং ইঞ্জিনিয়ার। ঘরের গণ্ডি পেরিয়ে সাইকেল চালিয়ে কাজে যাওয়া নারীরাই হয়ে উঠেছিল তাঁর নীরব বিপ্লবের চিহ্ন।

১৯৮২ সালে তিনি আরও এক কঠিন সংগ্রামে নামেন। বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকা ওষুধের বাজারে দাঁড়িয়ে তিনি প্রমাণ করলেন মানুষের অধিকার অটল। তাঁর নেতৃত্বে প্রণীত হয় জাতীয় ওষুধনীতি। হুমকি, চাপ ও ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও তিনি নড়েননি। মানুষের জীবন বাঁচানোই ছিল তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য, কারণ ওষুধ কেবল ব্যবসার পণ্য নয়, এটি মানুষের মৌলিক অধিকার।

শিক্ষাক্ষেত্রেও থেমে থাকেননি। ১৯৯৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর স্বপ্ন ছিল, মেধা কখনো দারিদ্র্যের কাছে হার মানবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রকাশনা, ফার্মাসিউটিক্যালস ও কৃষি—সবখানেই লক্ষ্য ছিল একটাই, স্বনির্ভর মানুষ তৈরি করা। তিনি দেখিয়েছেন, ডাক্তাররা শুধু চিকিৎসা করেন না, তারা সমাজের প্রতিচ্ছবি।

জীবনের শেষ দিনগুলোতে শরীর তাঁর সঙ্গে বিদ্রোহ করলেও মন ও কণ্ঠ অটল ছিল। দুটি কিডনি বিকল, নিয়মিত ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন। সাধারণ রোগীদের পাশে বসে চিকিৎসা করতেন। রানা প্লাজা হোক বা ছাত্র আন্দোলন, রাজনীতি হোক বা সামাজিক আন্দোলন, সব ক্ষেত্রেই সততা ও সেবা ছিলেন তাঁর মূলমন্ত্র। রাজনীতিকে নোংরা বিষয় বানাতে হয়নি—তার বিশ্বাস, যেখানে সহযোগিতা এবং ন্যায়, সেখানে রাজনীতি হয় সেবা। তিনি ছিলেন সেই “গরীবের ডাক্তার” যিনি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রমাণ করেছেন।

২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল তিনি চলে গেলেন। কিন্তু সাভারের সেই আমতলা জানে, তিনি চলে যাননি। কারণ কিছু মানুষ ইতিহাসে জায়গা করে নেয় মৃত্যুর পর নয়, জীবনের মধ্য দিয়েই। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন তেমনই একজন।

আজন্ম দ্রোহী
মানুষের বন্ধু
মানুষের বিবেক।

লেখক:শিক্ষার্থী, গণবিশ্ববিদ্যালয়

বিভি/এজেড

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2