কুড়িগ্রামে বিতর্কিত আ.লীগ নেতাদের প্রকাশ্যে আনাগোনা, প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
কুড়িগ্রামে বর্তমান জেলা প্রশাসক অন্নপূর্ণা দেবনাথ দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিকভাবে পরিচিত ও বিতর্কিত আওয়ামী লীগ ঘরানার ব্যক্তিদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ক্রমেই প্রকাশ্যে আসছে, যা গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
স্থানীয় রাজনৈতিক মহল ও নাগরিক সমাজের দাবি, জেলা প্রশাসক কুড়িগ্রামে যোগদানের পর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের বিতর্কিত নেতাদের প্রশাসনের আশপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। অভিযোগ অনুযায়ী, কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একাধিক মামলার আসামি আমানউদ্দিন মঞ্জুরের ঘনিষ্ঠ সহচর ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল বাতেন সরকার—যিনি অতীতে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন—বর্তমান জেলা প্রশাসকের আশপাশে নিয়মিত উপস্থিত থাকছেন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সাবেক জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানার সময়ে এসব ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে প্রশাসনের ঘনিষ্ঠতায় দেখা যায়নি।
এছাড়াও রাজাহাট উপজেলা আওয়ামী লীগের কৃষক লীগের সভাপতি আব্দুল লতিফ, কুড়িগ্রাম জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক রোকসানা বেগম লিপি এবং স্কাউটিং কার্যক্রমের আড়ালে সক্রিয় মোশারফ হোসেন ফারুকসহ আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ ঘরানার ব্যক্তির জেলা প্রশাসকের ঘনিষ্ঠতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব ব্যক্তির পরিবারের একাধিক সদস্য গুরুতর মামলার আসামি ও পলাতক অবস্থায় রয়েছেন।
একইভাবে আ ন ম খাইরুল ইসলামের প্রশাসনিক ঘনিষ্ঠতা নিয়েও আলোচনা চলছে। তাঁর আত্মীয় অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন একটি হত্যা মামলার আসামি এবং পলাতক রয়েছেন বলে স্থানীয়রা দাবি করছেন।
বিজয় দিবসে বিতর্কিত উপস্থিতি, ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক মহল
সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি হয়েছে আজ ১৬ ডিসেম্বর সকালে কুড়িগ্রাম বিজয়স্তম্ভে অনুষ্ঠিত বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, সেখানে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের মাঝখানে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল বাতেন সরকারকে অবস্থান করতে দেখা যায়। এ দৃশ্য দেখে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ প্রশাসনের কাছাকাছি যেতেও অনীহা প্রকাশ করেন।
অন্যদিকে, আজই জেলার বিভিন্ন স্থানে দুজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই বলে জানা গেছে। গ্রেফতারকৃতদের একজন ইউপি সদস্য। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন স্থানীয়রা—“বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা প্রশাসনের ছায়ায় থাকবেন, আর সাধারণ মানুষ গ্রেফতার হবেন—এটা কেমন বিচার?”
সীমান্ত জেলা কুড়িগ্রাম, বাড়ছে নিরাপত্তা শঙ্কা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা কুড়িগ্রামের মতো সংবেদনশীল জেলায় প্রশাসনের সামান্য পক্ষপাতও বড় অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে। সীমান্ত বাস্তবতার কারণে এখানে নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিবেশ সবসময় ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসনের ভূমিকা হওয়া উচিত সর্বোচ্চ সতর্ক, নিরপেক্ষ ও আস্থার।
কিন্তু বাস্তবে যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতাকর্মীদের আশ্বস্ত করছে না। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, প্রশাসনের ভূমিকার কারণে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা, সরকারের প্রতি নজরদারির দাবি
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সতর্ক করে বলেছেন, এভাবে চলতে থাকলে কুড়িগ্রাম আবারও ‘ফ্যাসিস্ট শক্তির দখলে’ চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরপেক্ষ পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে।
তাদের দাবি, এখনই সরকারের উচিত কুড়িগ্রামের প্রশাসনিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং জেলা প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে কঠোর নজরদারি করা।
গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও জননিরাপত্তা—কোনোটিই প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেওয়া যায় না বলেও তারা জোর দাবি জানান।
এ বিষয়ে এক তীব্র প্রতিক্রিয়ায় কুড়িগ্রামের শিক্ষাবিদ ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন, “একজন জেলা প্রশাসক হচ্ছেন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি—কোনো রাজনৈতিক দলের নন। সেখানে বিতর্কিত রাজনৈতিক নেতা আব্দুল বাতেন সরকারের মতো ব্যক্তির প্রকাশ্য ও ঘনিষ্ঠ উপস্থিতি প্রশাসনের নিরপেক্ষতাকে সরাসরি প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের মাঝখানে একজন রাজনৈতিক নেতার অবস্থান কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।”
তিনি আরও বলেন, “এটি শুধু প্রটোকলের লঙ্ঘন নয়, এটি প্রশাসনিক শালীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর আঘাত। যাদের রাজনৈতিক পরিচয় ও অতীত নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে, তাদের সঙ্গে প্রশাসনের এমন দৃশ্যমান ঘনিষ্ঠতা সাধারণ মানুষের মনে ভয় ও অনাস্থা তৈরি করে। প্রশাসন যদি এভাবে কোনো একটি দলের নেতাদের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে নিরপেক্ষ নির্বাচন ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ কীভাবে নিশ্চিত হবে—সেই প্রশ্ন আজ কুড়িগ্রামের মানুষ করছে।”
বিভি/এজেড




মন্তব্য করুন: