মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই পুত্রকে নিয়ে যেভাবে সংগ্রাম করেছিলেন খালেদা জিয়া
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছিল যার কণ্ঠ থেকে, সেই জিয়াউর রহমান তখন পরিবারের সঙ্গে নেই। তিনি পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে ‘রিভোল্ট’ করে প্রায় ৩০০ সৈন্য নিয়ে চলেছেন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে। তখন তাঁকে প্রশ্ন করা হলো— আপনার স্ত্রী ও দুই ছেলেকে কেন সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন না? মেজর জিয়া ওই সময় উত্তরে বলেন, যদি ৩০০ সৈন্য আমার নির্দেশে তাদের পরিবার ছাড়া যুদ্ধের জন্য যাত্রা করতে পারে, তাহলে আমি কেন পরিবার নিয়ে যাব?
বাংলাদেশের জন্য নিজের পরিবার, নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে যুদ্ধে যোগ দেওয়া এমন প্রথম সারির রাজনীতিক বা পরবর্তীতে রাষ্ট্র পরিচালনা করা নেতা ও পরিবারের সংখ্যা খুব কম আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা গেছে, বিশেষ করে পরে যারা বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতার দায়িত্ব পেয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা কেউ এ ধরনের ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলেন না। আগে-পরে রাজনৈতিক সংগ্রামে তারা সামনে ছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের সেই সাহস অনুপস্থিত ছিল। এক্ষেত্রে অনন্য জিয়া পরিবার।
যুদ্ধের জন্য জিয়াউর রহমানের সেই যাত্রার মধ্য দিয়ে শুরু হয় খালেদা জিয়ারও মুক্তিযুদ্ধ। দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি পালিয়ে বেড়িয়েছেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। যদি তিনি ধরা পড়ে যেতেন, তাহলে পাকিস্তান আর্মির হাতে সুযোগ ছিল জিয়াউর রহমানকে থামানোর। হয়তো স্বাধীনতার ঘোষণাও আটকে যেত। তবে, সেই সুযোগ তাদের দেননি খালেদা জিয়া। তাঁর কৌশল ও দৃঢ় মানসিকতার কাছে নতি স্বীকার করতে হয় পাকিস্তান আর্মিকে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেশকে স্বাধীন করতে প্রভাবক ভূমিকা পালন করেছিল, তার কয়েকটি নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তিনি জিয়াউর রহমানকে যুদ্ধ যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। পরিবার, সন্তানের জীবনের জন্যও তিনি আপস করেননি। জিয়াউর রহমানের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াননি। নিজের এবং দুই সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্যও আপস করেননি।
এছাড়া, আরেকটি ঘটনায় জানা যায়, সেই সময়ে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে অস্ত্র সরিয়ে নিতে আসে বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা। যাদের উদ্দেশ্য ছিল— এসব অস্ত্র বিদ্রোহী সেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন হাবিলদার জিয়াউর রহমানের বাসায় যান। সেখানে তখন জিয়াউর রহমান ছিলেন না। ওই হাবিলদার খালেদা জিয়ার কাছে তখন জানতে চান, স্যার কোথায় আছেন? খালেদা জিয়া বলেন, স্যার বাসায় নেই, কেন তাঁকে খুঁজছে তা জানতে চান। ওই হাবিলদার বলেন, ১৭ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা আমাদের ব্যাটালিয়ন থেকে অস্ত্র কেড়ে নিচ্ছে। খালেদা জিয়া তখন জানতে চান, কে তাকে পাঠিয়েছে? তিনি জানান, হাবিলদার কাদের। তারপর খালেদা জিয়া তাকে ফিরে যেতে বলেন এবং বলেন জিয়াউর রহমানের নির্দেশ ছাড়া কিছুই যেন বের না হয়। ওই হাবিলদার নুরুল হক পরবর্তীতে বলেন, বেগম জিয়া যদি সেদিন ওই নির্দেশ না দিতেন, তাহলে ১ হাজার ১০০ দেশপ্রেমিক সেনাকে ওইসব অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হতো।
বেগম খালেদা জিয়ার ওই নির্দেশে রক্ষা পায় মুক্তিকামী সেনাদের প্রাণ। স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে সক্ষম হন জিয়াউর রহমান। আনুষ্ঠানিক ওই ঘোষণায় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মানুষ জানতে পারে— দেশে যুদ্ধ চলছে।
খালেদা জিয়াকেও পালিয়ে থাকতে হয় এরপর থেকে। তিনি প্রথমে চট্টগ্রামেই পালিয়ে থাকেন তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায়। প্রায় দু’মাস নিজেকে এবং দুই ছেলেকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। তবে, চট্টগ্রাম আরো অনিরাপদ হয়ে ওঠে তাঁদের জন্য। সেখান থেকে দুই ছেলেকে নিয়ে প্রথমে যান নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জে তখন থাকতেন তাঁর বোন খুরশিদ জাহান হক। বেগম জিয়া তাঁর দুই ছেলেসহ নারায়ণগঞ্জ যান ১৯৭১ সালের ১৬ মে। তবে, এই যাওয়াও সহজ ছিল না। কালো বোরকায় নিজেকে ঢেকে চট্টগ্রামের লঞ্চঘাটে যেতে হয়েছিল তাঁকে। গাড়িতে লঞ্চঘাট যাওয়ার সময় নিয়মিত সড়ক ব্যবহার না করে তাঁকে বেছে নিতে হয়েছিল বিকল্প অপ্রচলিত পথ। কারণ, পাকিস্তানি সেনারা তখন মোড়ে মোড়ে ভারি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাহারা বসিয়েছিল। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে লে. মাহফুজের স্ত্রীসহ চট্টগ্রাম লঞ্চ টার্মিনাল থেকে লঞ্চে ওঠেন তিনি।
পুরো যাত্রায় তাঁর খেয়াল রাখতে হয়েছিল তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানের ওপর। তারা কেঁদে উঠলে বা কোনো আপত্তি করলে তা চোখে পড়ে যাবে পাকিস্তানি সেনাদের। বিশেষত আরাফাত রহমান কোকোর বয়স তখন দুই বছর। শিশু সন্তানের কারণে যেন কোনো সন্দেহ তৈরি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছিল বারবার। দুই শিশু সন্তানও হয়তো তখন বুঝতে পেরেছিল যুদ্ধের ভয়াবহতা।
নারায়ণগঞ্জে লঞ্চ পৌঁছামাত্র বোন খুরশিদ জাহান হক এবং তার স্বামী মোজাম্মেল হক সঙ্গে নিয়ে আসা গাড়িতে খালেদা জিয়া ও তাঁর দুই সন্তানকে তুলে নেন। সেই গাড়িতে ছিল রেডক্রসের স্টিকার। সেখান থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রক্তচক্ষুর সামনে দিয়ে তাঁরা পৌঁছান ঢাকার খিলগাঁওয়ে। তবে, অল্প সময়েই পাকিস্তানি সেনারা খালেদা জিয়ার বিষয়ে তথ্য পেয়ে যায়। তারা জানতে পারে যে, খালেদা জিয়া তাঁর এক আত্মীয়ের আশ্রয়ে আছে, যার নামের সঙ্গে হক আছে। তারা তখন মোজাম্মেল হকের অফিসে গিয়ে খোঁজ নেয়। এ খবরে মোজাম্মেল হক ২৮ মে খালেদা জিয়াকে নিয়ে যান ধানমন্ডিতে তাঁর এক চাচার বাসায়। তবে, সেখানেও নিরাপদ বোধ না করায় খালেদা জিয়া তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে সিদ্ধেশরীর এক বাসায় লুকিয়ে থাকেন। এ সময়ে গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হন মোজাম্মেল হক। তবে, অনেক নিপীড়নেও তিনি স্বীকার করেননি খালেদা জিয়া কোথায় আছেন।
অবশেষে ২ জুলাই গ্রেফতার হন খালেদা জিয়া। সেদিন সকালে তিনি ঘুম থেকে উঠে ওই বাড়ির বাগানে গিয়ে দেখেন চারপাশ থেকে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের ঘিরে রেখেছে।
গ্রেফতারের পর খালেদা জিয়া ও তাঁর দুই সন্তানকে প্রথমে পুরাতন সংসদ ভবন এবং পরে ঢাকা সেনানিবাসের একটি বাড়িতে রাখা হয়। ওই বাড়িতে তিনি ছিলেন দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত। যুদ্ধের সময়ে ভারতের গোলা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় এসে পড়তো বলে খালেদা জিয়া জানান। তিনি জানান, বোমা বিস্ফোরণের শব্দ তাদের মনে প্রচণ্ড ভয় ধরিয়ে দিত।
তবে, গ্রেফতারের সময় খালেদা জিয়া ছিলেন স্থির এবং চুপচাপ। এ সময়ে তাঁদের গ্রেফতার দেখিয়ে জিয়াউর রহমানকে আত্মসমর্পণের হুমকি দেওয়া হয়। এতেও বিচলিত হননি খালেদা জিয়া। জিয়াউর রহমান পাল্টা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ধমক দিয়ে চিঠি লেখেন।
সম্ভবত, ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শমসেরনগরে নিয়ে যাওয়া হয় খালেদা জিয়াকে। সঙ্গে ছিল তাঁর দুই সন্তান। এরপর কুমিল্লায় জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাঁরা থাকতে শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধে এমন বীরত্বপূর্ণ অবদান শুধু নয়। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় গঠনসহ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক অবদান রাখেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খালেদা জিয়ার অবদান বর্ণনা করতে গিয়ে এ. কে. এম. ওয়াহিদুজ্জামান লিখেছেন, ‘১৯৯১ সালে নির্বাচনে জিতে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া। দায়িত্ব নিয়েই তিনি দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৯২ সালের ১৫ ডিসেম্বর খেতাবপ্রাপ্ত সকল মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পদক দেওয়া হয়। কিন্তু, একজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না... তারামন বিবি বীরপ্রতীক। ১৯৯৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর তাঁকে খুঁজে বের করে নিজ হাতে পদক পরিয়ে দেন বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৯৩ সালে একাত্তরের বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন খালেদা জিয়া। গড়ে তোলা হয় রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। ২০০১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা সমুন্নত রাখতে গঠন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ২০০২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা ২০ থেকে ৬৬ শতাংশ বাড়ানো হয়। ২০০৩ সালে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে রাষ্ট্রীয় অনুদান দেওয়া হয়। উদ্যোগ নেওয়া হয় বীরশ্রেষ্ঠদের কবরের পাশে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের। ২০০৪ সালে খুলনায় বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্টেডিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০৬ সালে বেগম জিয়ার অনুরোধে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দেহাবশেষ বাংলাদেশে পাঠায় পাকিস্তান। তাঁকে সসম্মানে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শায়িত করা হয়। এ সময় ঢাকার প্রতিটি রাস্তার নামকরণ করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের নামে। বেগম জিয়া মুক্তিযুদ্ধকে নির্বাচনে জেতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেননি, মুক্তিযুদ্ধ ছিল তাঁর বিশ্বাসের অংশ।’
বিভি/এজেড




মন্তব্য করুন: