• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

থার্টিফার্স্ট নাইটের নামে আতশবাজির নির্মমতা

আহসানুল ইসলাম রাকিব, শিক্ষার্থী

প্রকাশিত: ১৪:১৮, ১ জানুয়ারি ২০২৩

ফন্ট সাইজ
থার্টিফার্স্ট নাইটের নামে আতশবাজির নির্মমতা

সময় নিরবিচ্ছিন্ন, আমরা সময় কেটে কেটে ভাগ করে নিয়েছি আমাদের কাজ এবং হিসাবের সুবিধার্থে শুধু। জীবন খণ্ডিত নয়, জন্ম থেকে মৃত্যু- পথটি বহুমাত্রিক হলেও বিযুক্ত নয়। জীবনের কোনো একটি বিশেষ ঘটনা বাদ দিলে হয়ত পরের ঘটনাগুলো আর পাব না। আমাদের হিসেবে একটি বছর চলে গেল, মানে জীবন কিছু ফুরালো। বিষয়টি আসলে দুঃখের,তাই নতুন বছরকে কেন্দ্র নয়, প্রতিনিয়ত খুঁজে নিতে হবে আমাদের আগামীতে সুন্দরভাবে বাঁচার দীপ্ত প্রত্যয়, যেনো জান্নাত হয় আমাদের স্থায়ী ঠিকানা। কারণ প্রকৃত উৎসবস্থল এবং আনন্দের উপযুক্ত স্থান জান্নাত। 

প্রতি বছর ইংরেজি তারিখের প্রথম প্রহরে ঢাকা শহরের আকাশে আতশবাজির ফুলঝুরিতে ছেয়ে যায়, হঠাৎ-আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে চিত্ত—তেমনটা মনে হওয়ার অবকাশও জোটেনি। বরং পিলে চমকানো শব্দে কানে লেগে যায় তালা।  প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছাদ থেকে হাউই ওড়ানো হয়, আতশবাজি ছুটে যায় আকাশে, আকাশে আলোর বান ডাকে; আর সমস্ত আকাশ ছেয়ে যায় ফানুসের আলোয় আলোয়। 

কিন্তু এর পরিণতি কী ভয়াবহ হয়েছে, তা উপলব্ধি করতে গেলে কেবল সলজ্জ হলেই চলছে না, বিষণ্ন, সতর্ক এবং সন্ত্রস্তও হতে হচ্ছে। আতশবাজিতে কয়েকশ পাখির মৃত্যু: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ইংরেজি নববর্ষ পালনের সময় পটকাবাজিতে ইতালির রোমের প্রধান রেলস্টেশনে কয়েকশ স্টারলিংস পাখি মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। আহত হয় বহু পাখি। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব প্রোটেকশন অব অ্যানিমেলস (ওআইপিএ) একে ‘হত্যাকাণ্ড’ আখ্যা দেয়। তারা পাখিদের মৃত্যুর জন্য উচ্চশব্দে পটকাবাজি ফোটানো ও আতশবাজি দায়ি করে।

শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক আহমেদুর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন:
‘আপনি যদি এই মুহূর্তে আমাদের দেশের একমাত্র বার্ন ইনস্টিটিউট শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে আসেন, আপনার বোধ অন্য রকম হতো। আমি নিজেও একটা দারুণ আতশবাজির ছবি তোলার জন্য ম্যানুয়াল মোডে ক্যামেরা তাক করে বসে থাকি, “আজন্ম সলজ্জ সাধ” মেটাতে ফানুস উড়াই; কিন্তু এর পেছনের কান্না আর কষ্টের গল্পগুলো নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি!'

‘একটা বাচ্চা এসেছে ফানুস ওড়াতে গিয়ে মোম পড়েছে চোখে-মুখে, একজন তরুণের সরাসরি চোখেই আগুনের হালকা লেগেছে; কর্নিয়া ইনজুরি আছে, একজন পথচারী এসেছেন, তারও মুখ ফানুসের আগুনে পুড়েছে, এক মাদ্রাসাছাত্র ফানুসের আগুনে বৈদ্যুতিক তার পুড়ছে দেখে সেটা নেভাতে গিয়ে নিজের হাত ইলেকট্রিক বার্ন নিয়ে এসেছে (সেই হাতে একটা বড় অপারেশন লাগবে), একজন “বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু” আতশবাজি কাছ থেকে দেখতে গিয়ে চোখ-মুখ পুড়িয়েছে; বেচারা তার সমস্যার কথা বলতেও পারছে না, বেশ কয়েকজন এসেছে পটকায় এক বা একাধিক আঙুল উড়ে গেছে, এমন আরও অনেকে এসেছে।’

ফানুসের কারণে অতীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের স্মেথউইক প্লাস্টিক রিসাইক্লিং প্ল্যান্টের অগ্নিকাণ্ড। ফানুস থেকে লাগা সেই আগুন নেভাতে ২০০ দমকলকর্মীর ৩ দিন লেগেছিল।

একই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন রাজ্যে ফানুসের আগুন থেকে একটি ৫০০ একরের জমিতে দাবানল শুরু হয়। এরপর গত বছর জার্মান তদন্তকারীরা জানান, ফানুসের মাধ্যমে আগুন লেগে দেশটির ক্রেফেল্ড চিড়িয়াখানায় বেশ কিছু প্রাণির মৃত্যু হয়। শুধু তাই নয়। ফানুসের কাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত তার ও বাঁশের ফ্রেমও যেন একেকটি মৃত্যুফাঁদ। আকাশে উড়তে থাকা অনেক পাখিরই ফানুসের সঙ্গে আটকে মৃত্যু ঘটে।

রসায়নবিদদের মতে, একটি আতশবাজিতে ৭৫ শতাংশ পটাশিয়াম নাইট্রেট, ১৫ শতাংশ চারকোল এবং ১০ শতাংশ পর্যন্ত সালফার থাকতে পারে। এগুলোর প্রত্যেকটিই পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর। তা ছাড়া বিকট শব্দ, তীব্র আলোর ঝলকানি এবং এর সঙ্গে যে পরিমাণ ক্ষতিকর রাসায়নিক কণা বাতাসে ছড়ায় তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলোর প্রত্যেকটিই পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর।

মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যেই ইতালির নাগরিকরা নতুন বছর উদযাপন করতে গিয়ে শতশত পাখির প্রাণ কেড়ে নিয়েছিলো। প্রাণি অধিকার রক্ষার আন্তর্জাতিক সংগঠন আইওপিএ রোম শহরের এই ঘটনাকে ‘গণহত্যার’ সঙ্গে তুলনা করেছে।

গতবার আতশবাজির শব্দে ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে তানজিম উমায়ের নামে এক শিশুর করুন মৃত্যু হয়েছিলো।

আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে কিন্তু আমরা কি সভ্য হচ্ছি? জলের ওপর থাকা জলযানে আগুন লেগে প্রাণ হারাচ্ছি, নতুন বছর উদ্‌যাপন করতে গিয়ে আহত হচ্ছি! আমাদের মনে হয় আরও একটু মানবিক ভাবনা করা দরকার; আমার উৎসব যেন আর কারও কষ্টের কারণ না হয়!’

পরিবেশ দূষণ এবং শব্দ দূষণের মতো ভয়াবহ নির্মমতা না করাই হোক নতুন বছরের অঙ্গীকার। সৃষ্টির সেবা করে স্রষ্টার মারেফত অর্জন করাই হোক আমাদের উৎসব। 

বিভি/টিটি

মন্তব্য করুন: