‘দুর্নীতিবাজদের জব্দকৃত সম্পদ বাজেটে যুক্ত করলে নতুন চমক হতে পারে’

ছবি: বিএফডিসিতে প্রাক-বাজেট নিয়ে আয়োজিত ছায়া সংসদে অংশগ্রহণকারী বিতার্কিকদের সঙ্গে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও হাসান কিরণ চৌধুরী
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচারকৃত অর্থ জব্দের মাধ্যমে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করলে তা হতে পারে এবারের বাজেটের একটি অভিনব উৎস। গত সরকারের রেখে যাওয়া বিদেশি ঋণের চাপ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিলো।’ শনিবার (৩১ মে) রাজধানীর এফডিসিতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র অয়োজনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট ছায়া সংসদে সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রধান অতিথির বক্তব্যে উক্ত কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, এই সরকারের এই সময়কালের অন্যতম সাফল্য ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে বিদেশি ঋণের চাপ কমিয়ে আনা। যা বিলিয়ন ডলার করে বছর বছর বাড়ছিলো। সামগ্রিকভাবে এই সরকারের সাফল্যের জায়গাটা হলো বহির্খাত, রেমিট্যান্স, রফতানি, দায়দেনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, মজুদ বাড়ানো ও টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল রাখা। দুঃখজনকভাবে এবারের বাজেটও গতানুগতিক হতে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরৎ এবং করের আওতা বাড়ানোর মতো নতুন কোন কিছু না থাকায় এবারের বাজেটে নতুন কোন চমক থাকছে না। যে প্রকল্পগুলো সরকারের কাছে আছে তা অতিমূল্যায়িত ও তার ৪০ শতাংশ ব্যয়ই ভুয়া। আগের যে প্রকল্পগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হতো সেগুলো অব্যাহত আছে। রাজস্ব ব্যয় সঠিকভাবে না করলে করদাতাদের উৎসাহ থাকে না। আমাদের কর কাঠামো বৈষম্যনির্ভর। আমাদের বৈদেশিক খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা অর্জিত হলেও, ব্যক্তিখাতে স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ এখনো আশানুরূপ অর্জিত হয়নি।
সভাপতির বক্তব্যে হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, কর ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা, বৈষম্য, দুর্নীতি ও অন্যায্যতা বহাল রেখে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। আমাদের মতো দেশে বাজেট বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। বিগত সরকারের আমলে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীদের নেক্সাসে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে ঘোষিত হতে যাচ্ছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। বিগত সরকারের আমলে প্রত্যেকটি বাজেটকে ব্যবহার করা হয়েছিল লুটপাটের স্বার্থে। জাতিকে এখন সেই লুটপাটের বোঝা বহন করতে হচ্ছে। আমাদের ঘাড়ে বিগত সরকার ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। বর্তমানে আমাদের গড়ে প্রতিবছর দুই থেকে আড়াই বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। আগামীতে এই ঋণ পরিশোধের হার আরও বাড়বে। বিগত সময়ে দেশে মাফিয়া ইকোনমির শাসন ছিল। গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশের অর্থনীতিকে চৌর্যবৃত্তির ওপর দাঁড় করানো হয়েছিল। আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত না হলে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। আমদানি-রফতানি ব্যাহত হবে। বাজেট বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জে পড়বে।
আহমেদ চৌধুরী কিরণ আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত বিগত আমলের অর্থপাচারকারী, দুর্নীতিবাজ ও ঋণ খেলাপিদের আইনের আওতায় আনতে তাদের নাম প্রকাশ করে দৃশ্যমাণ শাস্তির ব্যবস্থা করা। তা না হলে ক্ষমতার পালা বদলের সাথে সাথে শোষণ ও দুর্নীতির পালা বদল হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এই ক্রান্তিকালে আসন্ন বাজেটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু, দেশের চলমান যে পরিস্থিতি তাতে এই বাজেট জনআকাঙ্খা পূরণে সমর্থ হবে কি না তা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা বর্তমান কর ব্যবস্থা দিয়ে সম্ভব নাও হতে পারে। কর জালের পরিধি না বাড়িয়ে যারা কর দেয় শুধু তাদের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দিলে অর্থনীতি ভারসাম্য হারাবে। এনবিআরে বর্তমানে যে অস্থিরতা চলছে তার ওপর ভর করে আগামী বাজেটে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধি চ্যালেঞ্জে পড়তে পারে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো না গেলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাজেটও নতুন মোড়কে পুরাতন গল্পই লেখা হবে।
এ সময় হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ আসন্ন বাজেটকে জনমূখী করাসহ রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১০ দফা সুপারিশ করেন। ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে ‘রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করা আসন্ন বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত’ শীর্ষক ছায়া সংসদে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজকে পরাজিত করে ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজির বিতার্কিকরা বিজয়ী হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, প্রফেশনাল একাউন্টেন্ট আবুল বশির খান, সাংবাদিক উম্মন নাহার আজমী, সাংবাদিক আবুল কাশেম এবং সাংবাদিক মো: আতিকুর রহমান। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।
বিভি/পিএইচ
মন্তব্য করুন: