সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার: চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা
২০২০ সালের পর থেকে সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। দিন যত যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বার্তাকক্ষে এআইয়ের ব্যবহার তত বাড়ছে। ওয়াশিংটন পোস্ট, রয়টার্সসহ বিশ্বের খ্যাতনামা মিডিয়া হাউজগুলো সফলভাবে ব্যবহার করছে এআই টুলস।
সম্প্রতি (২২ এপ্রিল, ২০২৪) দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড জার্নালিস্ট কনফারেন্সে সাংবাদিকতায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) নিয়ে একটি সেশন অনুষ্ঠিত হয়। হোটেল প্রেসিডেন্টে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৪৬টি দেশের ৫৩ জন সাংবাদিক। এরকম একটা সম্মেলনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে আমি খুবই সম্মানিত বোধ করি। নানান দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় হয়। কথা হয়। জানার চেষ্টা করি ওইসব দেশের সাংবাদিকতা, সমাজ, রাজনীতিসহ নানা বিষয়। একটা বিষয় অভিন্ন মনে হয়। সেটা হলো স্বাধীন সাংবাদিকতা কমবেশি সব দেশেই চ্যালেঞ্জের মুখে। কোথাও হয়তো বেশি কোথাও কম।
যাইহোক, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আয়োজিত সেশনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানা মিডিয়ার নিউজরুমে এআই কিভাবে ভূমিকা পালন করছে তা তুলে ধরেন কয়েকজন সাংবাদিক। তাদের বক্তব্যের সারবত্তা এখানে তুলে ধরছি। বর্তমানে শুধু গণমাধ্যমে নয় সবক্ষেত্রে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গণমাধ্যমে এআই এর ব্যবহার নিয়ে যে তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে বিতর্ক আবর্তিত হচ্ছে তা হলো এআইয়ের সুবিধা, চ্যালেঞ্জ এবং অসুবিধা বা নেতিবাচক দিক। সাংবাদিকতায় এআই এর ব্যবহার ভবিষ্যতে খাপ খাওয়ানো যাবে কিনা তা নির্ভর করে সাংবাদিকের এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা, গণমাধ্যমে এর ব্যবহারে নৈতিক প্রায়োগিকতা এবং এর ঝুঁকি ও সর্বোচ্চ সুবিধা নেয়ার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ওপর।
সাংবাদিকতায় এআই ব্যবহার উপকারি নাকি ক্ষতিকর তা নির্ভর করে সফটওয়ারের গুণগত মান, ব্যবহারের মাত্রা, সম্পাদনা স্বাধীনতার ওপর এর প্রভাব, সাংবাদিকের প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা এবং সাংবাদিকতার মানদন্ড ও নৈতিকতা কতটুকু রক্ষা করা সম্ভব হবে তার ওপর। কারণ এখন পর্যন্ত এআই ব্যবহারের কৌশল নিয়ে কোন ফর্মাল গাইডলাইন তৈরি হয়নি। তবে তারপরও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমের বার্তাকক্ষে এআই ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষত নিউজ কিউরেশন, নিউজলেটার প্রস্তুত, অনুবাদ, ফ্যাক্ট চেকিং, পেওয়াল ব্যবস্থাপনা এবং অডিয়েন্স তথা দর্শক-পাঠক-শ্রোতাকে সম্পৃক্ত করার কাজে এআই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে।
যেমন দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের ‘হেলিওগ্রাফ’ এবং চেক রেডিওর ‘ডিজিটাল রাইটার’ সুসজ্জিত ডাটা থেকে নিউজ আর্টিকেল তৈরি করে, রয়টার্সের ‘লিনক্স ইনসাইট’ তথ্য বিশ্লেষণ করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করে। আবার রয়টার্সের ‘নিউজ ট্রেসার’ ব্রেকিং নিউজ চিহ্নিত এবং ভেরিফাই করতে যেমন সক্ষম তেমনি ‘নিউট্রালস ক্লেইম হান্টার’ প্রযুক্তি অডিও কন্টেন্টের ফ্যাক্ট চেকিংয়ে সক্ষম। লাইভ ইভেন্টের ফ্যাক্ট চেক করতে ব্যবহৃত হয় ডিউক রিপোর্টার্স ল্যাবস ফ্যাক্টস্ট্রিম। কোন প্রতিবেদনের হেডলাইন সাজেস্ট করতে, বিশাল ডকুমেন্ট কিংবা প্রতিবেদন অথবা আর্টকেল মূল পয়েন্টসহ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সংক্ষিপ্ত করতে, অডিও থেকে টেক্সট এবং টেক্সট থেকে অডিও করতে, তথ্য বিশ্লেষন ও কোডিং করতে, প্রুফ রিডিং, সম্পাদনা করতে সাংবাদিকরা এআই ব্যবহার করে থাকে। এর ব্যবহার সময় অনেক কমিয়ে দেয়।
কেউ কেউ বলেন, যুদ্ধ বা সংঘাতপ্রবণ এলাকায় এআই দিয়ে সাংবাদিকতা করা যায়। যুদ্ধরত এলাকায় এআই রোবোট দিয়ে তথ্য, ভিডিও সংগ্রহ করা যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনা হয়। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকদের জীবনের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। তবে এআই ব্যবহার করে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ পোষণ করেন কোন কোন বক্তা। বর্তমানে অবশ্য অনেক দেশেই এআই মানব-মানবী দিয়ে সংবাদ পাঠ করানো হচ্ছে। বিষয়টি আমাদের দেশেও অপরিচিত নয়। তবে সত্যিকারের মানুষ যে ধরনের আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করে খবর পাঠ করতে পারে তা এআইয়ের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।
সাংবাদিকতায় এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের কিছু চ্যালেঞ্জ বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন এআই দিয়ে সাংবাদিকতার নৈতিক মানদন্ড কতটুকু বজায় রাখা সম্ভব সেটা একটা প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার। সংবাদ কাভারেজের ক্ষেত্রে এআই সম্ভাব্য পক্ষপাতিত্ব উসকে দিতে পারে যা সংবাদের ইন্টিগ্রিটি বা সততা এবং বিশ্বাসযোগত্যাকে প্রশ্নবিদ্ধে করতে পারে। কারণ এআই সিস্টেম ততটুকুই ভাল যতটুকু ডাটা সম্পর্কে একে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছাড়াই এআই তার মূল্যায়নে শুধুমাত্র ট্রেইনড ডাটারই প্রতিফলন ঘটাতে পারে। এভাবে সমাজে বিদ্যমান পক্ষপাতিত্ব বা স্টেরিওটাইপ সংবাদের ক্ষেত্রে এআই দ্বারা ঢুকে যেতে পারে।
এ কারণে সাংবাদিকতার ইন্টিগ্রিটি রক্ষায় মানবীয় মূল্যায়নের ঝুঁকি থেকেই যায়। এআইয়ের ব্যবহার সাংবাদিকের ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করতে পারে। এআইয়ের সবচেয়ে ক্ষতিকর বা খারাপ দিক হলো ভবিষ্যতে এর বর্ধিত ব্যবহার মানুষের কর্মসংস্থান কমিয়ে দিতে পারে। এটা মানবীয় সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটা বড় হুমকি হয়ে আবির্ভুত হতে পারে।
এআই পাওয়ার্ড ফেক নিউজ ও ডিপফেক সমাজে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন মানহানির উদ্দেশ্যে এআই দিয়ে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিকৃত ভিডিও তৈরি করে কিংবা ভয়েজ রেকর্ডিং করে ছড়িয়ে দেয়া যায়। এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় ফ্যাক্ট চেকিং, ভেরিফিকেশন এবং স্বচ্ছতার ওপর জোর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রেও বড় ঝুঁকি হলো এআই মুহুর্তের মধ্যে মিলিয়ন মিলিয়ন অসত্য মেসেজ তৈরি করে ছড়িয়ে দিতে পারে যা ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক।
এতসব ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সাংবাদিকতায় দিনকে দিন এআইয়ের ব্যবহার বেড়ে চলেছে। তাই কিভাবে স্বচ্ছতার সাথে এআইয়ের ইথিক্যাল ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় তার ওপর জোর দেন বক্তারা।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: