• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

অনুসন্ধানের দ্বিতীয় পর্ব

ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুতের তারের নিচে বাড়িঃ আর কতো প্রাণ নেবে?

সাদ্দাম হোসাইন ও আহসান হাবীব

প্রকাশিত: ১৭:১২, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

আপডেট: ১৯:৪১, ১৫ আগস্ট ২০২২

ফন্ট সাইজ

ভবন থেকে এক হাতেরও কম দূরত্বে ঝুলছে জাতীয় গ্রিডের ১ লাখ ৩২ হাজার কিলো ভোল্ট বিদ্যুতের তার। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এভাবেই স্থাপনা নির্মাণ করেছেন ভবন মালিকরা।

জাতীয় গ্রিডের নীতিমালা বলছে, বৈদ্যুতিক হাইভোল্টেজ তারের ন্যূনতম ৩ দশমিক ৮ মিটার বা সাড়ে ১২ ফুটের কাছাকাছি কোনো ভবন কিংবা স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু রাজধানীর উত্তর বাড্ডার রাসুলবাগ এলাকায় ৪১০ নম্বর ভবনের পাশে গড়ে ওঠা দুটি ভবনের ছাদ উচ্চমাত্রার বৈদ্যুতিক তার থেকে মাত্র এক হাতেরও কম দূরত্বে নির্মাণ করা হয়েছে। ভবন দুটির মালিক হলেন ইমান আলী ও তাঁর সহোদর আব্দুল আলী। 
 
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (পিজিসিবিএল) ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) কর্মকর্তা মো. বদরুল আমিন বলছেন, নীতিমালা না মেনে স্থাপনা নির্মাণের কারণে ব্যবহারকারীরা দুর্ঘটনায় প্রাণনাশের ঝুঁকিতে থাকেন। পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতির শিকার হতে হয় রাষ্ট্রকে। উচ্চমাত্রার বৈদ্যুতিক তারে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে বিদ্যুৎ সংকটে অনেক সময় শিল্পকারখানার কার্যক্রমও ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থবির হয়ে পড়ে।

নীতিমালা অনুযায়ী যদি উচ্চমাত্রার বৈদ্যুতিক তারের সাড়ে ১২ ফুটের ভেতরে কোনো ভবন বা স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ না থাকে, তবে কীভাবে ইমান আলী ও তার ভাই ভবন নির্মাণ করেছেন? আবার সেই ভবন বছরের পর বছর ধরে ব্যবহারও করছেন? এসব বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হয় স্থানীয়দের সংগে। প্রকাশ্যে ক্যামেরায় কথা বলতে রাজী না হলেও স্থানীয়রা জানান, ইমান আলীরা প্রভাবশালী হওয়ায় অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছেন। তবে বারবার একই স্থানে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, পাওয়ার গ্রিডের বৈদ্যুতিক তারের কারণে একাধিকবার দুর্ঘটনা ঘটলেও ভবন মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় কোনো প্রতিকার মেলেনি।

ভবন মালিক ইমান আলী'র কাছে কার অনুমতিতে ভবন নির্মাণ করা হয়েছিলো জানতে চাইলে তিনি জানান, অন্যরা এভাবে ভবন নির্মাণ করছে। তাই তিনিও এমনটি করেছেন। ভুল শিকার করে ভবনটি ভেঙে ফেলার কথাও বলেন তিনি।

স্থানীয়রা জানান, ঝুঁকির্পূণভাবে গড়ে ওঠা এই ভবনের কারণে ২০২০ সালের ২০ জুলাই রাত সাড়ে আটটার দিকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন খায়রুল ইসলাম নামের এক যুবক। চারদিন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা যান খায়রুল। একই স্থানে একবছর পর গত রবিবার আবারও ঘটেছে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ঘটনা। ইমরান নামের এই শ্রমিক প্রাণে বেঁচে গেলেও দগ্ধ শরীরের ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন।

বিদ্যুৎস্পৃষ্টে আহত ইমরান জানায়, মোবাইলে কথা বলতে বলতে ওই ভবনের তিন তলায় যান তিনি। এইসময় হঠাৎ ছাদের উপর থেকে বিকট শব্দ হয় এবং আগুনের ফুলকি এসে পড়ে তাঁর গায়ে। 

অভিযোগ রয়েছে, ২০২০ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে খায়রুলের মৃত্যু ঘটেছে বলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকলেও এটি ভিন্ন দিকে নিতে মিথ্যা গল্প সাজিয়ে খায়রুলের বাবাকে দিয়ে মামলা করান ভবন মালিক ইমান আলী। ফলে ঝুঁকির্পূণ ভবনের কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও পার পেয়ে যান তিনি। উল্টো দায় চাপানো হয় পাশের ভবনের একটি পরিবারের উপর। খায়রুলের মৃত্যুর গল্পে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় ইয়াকুব আলী নামে এক ব্যবসায়ীকেও। এ বিষয়ে সম্প্রতি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাভিশন ডিজিটাল। এরপর ঘটনাটি আবারও তদন্ত করছে সিআইডি'র সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম।

ভবন থেকে এক হাতেরও কম দূরত্বে ঝুলছে জাতীয় গ্রিডের ১ লাখ ৩২ হাজার কিলো ভোল্ট বিদ্যুতের তার
স্থানীয় ভুক্তভোগী বাসিন্দা নাজনীন আহমেদ নিথী বলেন, এক বছর আগে যখন বিদ্যুতের তারের কারণে একজন মারা গেলো, তখন আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হলো। তখন বলছিলো, আমরা কেরোসিন তেল দিয়ে ওই ব্যক্তিকে মেরেছি। কিন্তু এবার তো দিনে দুপুরে ঘটলো। সবাই দেখলো। তাহলে এবার কেরোসিন তেল ছাড়া কীভাবে ইমরান নামের ওই লোক পুড়লো? 

একই কথা বলেন অপর ভুক্তভোগী বাসিন্দা ইয়াকুব আলী। তিনি বলেন, গত বছর খায়রুল নামের এক যুবক বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা গেছেন। তখন ওই ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। কিন্তু ঘটনার এক বছর পর আমাকে হঠাৎ সিআইডি কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে বলা হলো ওই যুবকের মৃত্যুর সংগে আমি জড়িত। তারা আমাকে বললো, আমি নাকি কেরোসিন তেল দিয়ে এসেছি ওই যুবককে মারার জন্য। কিন্তু এবার তো দিনে দুপুরে বিদ্যুতের তারের কারণে দুর্ঘটনায় একজন শ্রমিক আহত হলো। হাসপাতালে ভর্তি। তাহলে তাঁকে কে কেরোসিন দিয়ে পোড়ালো? এটার জবাব কে দেবে?

নীতিমালা উপেক্ষা করে কীভাবে নির্মিত হচ্ছে ভবন, এই ধরনের ঘটনায় কী ব্যবস্থাই বা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের বাড্ডা অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী তাজেদুল ইসলাম বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, নিয়ম উপেক্ষা করে স্থাপনা গড়ে তুললে ভবন মালিকদের লিখিতভাবে নোটিশ দিয়ে সেই ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সেভাবেই ইমান আলীদের ভবন-এর বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহাগর পুলিশের বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, ইমান আলীর বিষয়টি পুলিশের নজরে এসেছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে ইমান আলী যতোই প্রভাবশালী হোক কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানান তিনি। ঘটনাটি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও বলেন তিনি। 

জান-মালের স্বার্থে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

এ অনুসন্ধানের প্রথম পর্ব- মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে মেয়েকে হত্যার হুমকি, মিথ্যা সাক্ষী দিতে ‘বাধ্য করে সিআইডি’

বিভি/এসএইচ/এএইচ/এসডি

মন্তব্য করুন: