• NEWS PORTAL

  • বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

Drama: Jamai Bou Chor
Drama: Jamai Bou Chor

অনুসন্ধানের প্রথম পর্ব

মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে মেয়েকে হত্যার হুমকি, মিথ্যা সাক্ষী দিতে ‘বাধ্য করে সিআইডি’

সাদ্দাম হোসাইন ও আহসান হাবীব

প্রকাশিত: ১৭:৩০, ৩১ আগস্ট ২০২১

আপডেট: ১৯:৩৯, ১৫ আগস্ট ২০২২

ফন্ট সাইজ

সিআইডি কার্যালয়ে টানা চারদিন ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে এভাবে ডুকরে কাঁদছিলেন সাহিলী বানু। তাঁর অভিযোগ, ইয়াকুব আলী নামের এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে ও তাঁর মেয়েকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তাঁর মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে বড় মেয়েকে হত্যার হুমকি দিয়ে সাক্ষী দিতে বাধ্য করে সিআইডি। ওই মিথ্যা সাক্ষীর জন্য বিনা অপরাধে দেড় মাস জেলও খাটতে হয়েছে ইয়াকুব আলীকে নামের এক ব্যবসায়ীকে।

সিআইডি’র ঢাকা মেট্রো উত্তর বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার খালিদুর রহমান হাওলাদারের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন সাহিলী বানু। তিনি জানান, মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ার পরও নির্যাতন থেকে বাঁচতে দুই লাখ টাকা দিতে হয়েছে সিআইডির ও কর্মকর্তাদের।

তিনি আরও জানান, ইয়াকুব নামের ওই ব্যক্তিকে সিআইডি অফিসে প্রথমবারই দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধেই মিথ্যা স্বাক্ষী দিতে মানসিক ও শারীরিত নির্যাতন করে সিআইডির সংশ্লিষ্টরা। পরে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে মিথ্যা স্বাক্ষী দেন তাঁরা মা মেয়ে।

সাহিলী বানু বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, গত ১০ জুন আমাকে ও আমার বড় মেয়ে নিথীসহ পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায় মালিবাগের সিআইডি অফিসে। সেখানে আমাদেরকে হাত পা ও চোখ বেঁধে নির্যাতন করে সিআইডির অফিসাররা। এসব কাজের মূল নেতৃত্বে ছিলেন এসপি খালিদুর হক হাওলাদার। তাঁর নির্দেশে আমাদেরকে সেখানে নিয়ে যান এসআই দোলন।

তিনি বলেন, আমাদেরকে সিআইডি অফিসে নিয়ে মারধর করে বলা হয় ইয়াকুব নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বাক্ষী দিতে। কিন্তু আমি বলছি, আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। আল্লাহর ভয় আছে। আমি কেনও অহেতুক নির্দোষ একজন মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বাক্ষী দিবো। আমি তো এই মানুষটাকে আগে কখনও দেখিওনি। এটা বলার পর আমাকে বাথরুমে নিয়ে বিবস্থ করিয়ে নির্যাতন করতো। ইলেক্ট্রিক শক দিতো।

তিনি বলেন, টানা চারদিন সিআইডি অফিসে এমন নির্যাতন আর সহ্য করতে পারছিলাম না। মনে মনে শুধু দোয়া পড়তাম আর আল্লাহকে বলতাম, হে আল্লাহ এ কেমন পরীক্ষায় ফেললেন। এর চেয়ে মৃত্যুই তো ভালো ছিলো। নির্যাতনের সেসময়গুলো বলার মতো না। 

'আমি যখন মিথ্যা স্বাক্ষী দিচ্ছিলাম না তখন তারা আমার মেয়েকে আমার সামনে এনে পিস্তল ঠেকিয়ে বলতো স্বাক্ষী না দিলে আমার মেয়েকে মেরে ফেলবো। তারা বলতো আমার মতো আমার মেয়ে যুবতী মেয়েকেও তারা বিবস্থ করে নির্যাতন করবে। এসব শুনে আর সহ্য করতে পারিনি। আর এ কারণেই ইয়াকুব নামের ওই লোকটারে দেড় মাস জেল খাটিয়েছে তারা (সিআইডি)। 

একই অভিযোগ সাহেলী বানুর মেয়ে নাজনীন আহমেদ নিথী'র। তিনি বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, সিআইডি কার্যালয়ের সে সময়ের নির্যাতনের ভয়াবহতা এখনও আমাদেরকে দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে। নির্যাতনে আমার মা চরমভাবে ভেঙে পড়েছেন। মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরেও চিৎকার করে উঠেন। প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমাদের কোনো অপরাধ নেই। তবুও আমরাও নির্যাতনের শিকার হলাম। দেড় বছর ধরে বাবাও পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের সংগে সিআইডির ভয়ে বাবাও যোগাযোড় করছেন না। আমরা চরম অর্থ সংকটেও ভুকতেছি। এসবের মধ্যেও সিআইডির হয়রানি থেমে নেই। আমরা এর থেকে নিস্তার চাই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছর ২০ জুলাই রাত সাড়ে আটটার দিকে রাজধানীর উত্তর বাড্ডার রসুলবাগ এলাকার ৪১০ নম্বর ভবনের ছাদে প্রেমিকা নাননীন আহমেদ নিথী'র সংগে লুকিয়ে দেখা করতে আসেন খায়রুল ইসলাম নামের এক যুবক। কিন্তু তাদের প্রেমের বিষয়টি জানতো না নিথীর মা সাহেলী বানু ও তাঁর পরিবার। ওইদিন নিথীর সংগে দেখা করার সময় ছাদে বিদ্যুতের তারে স্পৃষ্ট হন খায়রুল। দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি করা হয় তাকে। চারদিন পর হাসপাতালে মৃত্যু হয় খায়রুল ইসলামের।

এ ঘটনায় খায়রুলকে হত্যা করা হয়েছে- এমন অভিযোগে বাড্ডা থানায় মামলা করেন তাঁর বাবা আব্দুল কুদ্দুস শিকদার। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সুরতাহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, খায়রুল বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা গেছেন। এমনকি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের কথা উল্লেখ করেন চিকিৎসক। কিন্তু খায়রুলের বাবা বিষয়টি মানতে রাজী হননি। তাই মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডি'র কাছে আবেদন করেন তিনি। এরপরই ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়।

তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর গত ১০ জুন অভিযুক্ত প্রেমিকা ও তার মাসহ পাঁচজনকে সিআইডি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। ওইদিন রাত তিনটার দিকে ব্যবসায়ী ইয়াকুব আলী নামে এক ব্যক্তিকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। ওই ব্যবসায়ীর অভিযোগ, তুলে নিয়ে গিয়ে খায়রুল হত্যায় সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয় তাঁকে। সেখানে টানা তিন দিন তাঁকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে নেওয়া হয় বলেও জানান তিনি।

ইয়াকুব আলী বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, গত ১০ জুন রাত তিনটার দিকে আমি আমার বেকারি অফিসে ঘুমাচ্ছিলাম। এসময় সিআইডির লোকজন এসে আমাকে মালিবাগের অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে আমার হাত হ্যান্ডকাপ পরিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। এরপরই শুরু করে অমানবিক নির্যাতন। 

তিনি বলেন, কেনো আমাকে নির্যাতন করা হচ্ছে জানতে চাইলে তারা বলেন, খায়রুল হত্যাকাণ্ডে আমি নাকি নিথীর বাবাকে কেরোসিন কিনে দিছা। অথচ তাদের এসব ঘটনার কিছুই আমি জানি না। কবে খায়রুল মারা গেলো। কবে কি হলো কিচ্ছু আমি জানতাম না। তারা আমাকে বলে, নিথীর বাবা আমাকে ফোন দিয়ে কেরোসিন নিয়ে যেতে বলেছিলো। তখন আমি তাদেরকে বললাম যদি আমাকে কল করে তাহলে আমার ফোন চেক করেন। কিন্তু তারা সে প্রমান আমাকে দেখাতে পারেনি। তবুও আমাকে টানা ৬০ ঘন্টা সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে নির্যাতন করে। নির্যাতনের কারণে আমি অসুস্থ হয়ে গেলে আমাকে তারা রাজারবাগ হাসপাতালে ভর্তি করায়। এরপর তারা আমাকে জানায় আমি যদি দশ লাখ টাকা তাদেরকে দিই তাহলে আমাকে তারা ছেড়ে দিবে। আর তা না হলে জেলে দিবো। তখন আমি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমাকে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠায়।

আমি দেড় মাস জেল খেটে ২৮ জুলাই মুক্তি পাই।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সিআইডির মতো একটা সংস্থা কিভাবে এমনটা করতে পারে? আমি ঘটনার সংগে কোনভাবেই জড়িত নই। আবার আমার বিরুদ্ধে বাদীরও কোনো অভিযোগ ছিলো না। তবুও আমাকে নির্যাতন করলো। আবার টাকা না দিতে পারায় জেলে দিলো। আমি এসবের সুষ্ঠু বিচার চাই।

খায়রুলের বাবার সংগে আসামি পক্ষের একটি ফোনালাপ বাংলাভিশন ডিজিটালের হাতে এসেছে। ফোনালাপে খায়রুলের বাবা আব্দুল কুদ্দুসকে বলতে শোনা যায়, সিআইডি আমাকে ১৮ দিন আটকে তাঁকে শেখানো কথা বলতে বাধ্য করেছে। এভাবে নাটক বানানো হবে এবং কারো ক্ষতি হয়ে যাবে সেটা তিনি বুঝতে পারেননি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডি'র ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) বিশেষ পুলিশ সুপার খালিদুর হক হাওলাদার মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ঢাকা মেট্রো, উত্তর-এর অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুকের কাছে জানতে চাইলে তিনিও ক্যামেরায় কথা বলতে রাজী হননি। তবে মুঠোফোনে তিনি জানান, যেহেতু তদন্ত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাই সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে বিষয়টি এখন সিআইডি’র সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম তদন্ত করছে।

পরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের বিশেষ পুলিশ সুপার সাঈদুর রহমান খান বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, আমরা ঘটনাটির তদন্ত শুরু করেছি। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

তবে ভুক্তভোগীরা মামলাটির সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে হয়রানি থেকে মুক্তি চান। এজন্য প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট উধ্বর্তন পুলিশ প্রধানদের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

এ সংশ্লিষ্ট সংবাদের দ্বিতীয় পর্ব- ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুতের তারের নিচে বাড়িঃ আর কতো প্রাণ নেবে?

বিভি/এমএস

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2