• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

নামসর্বস্ব হাসপাতালের দুর্নীতির চিত্র: পর্ব-০২ 

আইসিইউ বেডে রোগী ভর্তি করে টাকা হাতাচ্ছে ঢাকা হেলথকেয়ার হাসপাতাল

সাদ্দাম হোসাইন ও আহসান হাবীব

প্রকাশিত: ২৩:১২, ১২ অক্টোবর ২০২১

আপডেট: ১৪:০৫, ১৩ অক্টোবর ২০২১

ফন্ট সাইজ

বেলাল হোসেন। স্ত্রী নাসিমা আক্তার এবং এক শিশু সন্তান নিয়ে নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে বসবাস করেন। ১৫ সেপ্টেম্বর রাত নয়টার দিকে নাসিমা আক্তার গার্মেন্টস থেকে বাসায় ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে তাঁকে দ্রুত নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে জরুরি চিকিৎসা শেষে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক নাসিমাকে মিরপুর-১৪-তে ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। এসময় একজন দালাল বেলাল হোসেনকে ঘিরে ধরে নানান পরামর্শ দিতে থাকে। জানায়, কলেজ গেট সংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার-১-এর ঢাকা হেলথকেয়ার হাসপাতালে অল্প টাকায় তাঁর স্ত্রীর ভালো চিকিৎসা হবে।  এক পর্যায়ে দালালের কথা মতো ঢাকা হেলথকেয়ারে নেওয়া হয় নাসিমা আক্তারকে।

এই হাসপাতালে আনার পর কিছু বুঝে ওঠার আগেই নাসিমাকে নেওয়া হয় আইসিইউতে। অল্প খরচে চিকিৎসা পাবেন, এমন আশ্বাসে  ঢাকা হেলথকেয়ারে এসে চরম বিপাকে পড়েন বেলাল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই প্রতিবেদককে জানান, রোগী সুস্থ হওয়া তো দূরের কথা, মাত্র ১২ ঘণ্টায় হাসপাতালটিতে ওষুধসহ সব মিলিয়ে বিল হয়েছে ৪১ হাজার টাকা। বিলের এই অংক গুণে দিশেহারা বেলাল। তাই আইসিইউতে থাকা স্ত্রীর চিকিৎসা না করিয়েই ছাড়পত্র নিয়ে গ্রামে চলে যেতে চান তিনি। বারবার হাসপাতালের লোকজনদের কাছে কেঁদে কেঁদে মিনতিও করেছেন। কিন্তু লোভী এবং অমানবিক মানুষগুলোর কাছে বেলালের চোখের পানি কোনো  মূল্য পায়নি।

বেলাল হোসেন বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, আমার স্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে তাকে স্থানীয়দের সহযোগিতায় ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। সেখানে চিকিৎসকরা জরুরি চিকিৎসা দিয়ে আমাকে বলেছিলন, মিরপুর-১৪-এর ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে। সেই অনুযায়ী স্ত্রীকে মিরপুরে নেওয়ার প্রস্তুতির সময় একজন ব্যক্তি এগিয়ে এসে বললো, চলেন ডাক্তার যে হাসপাতালে নিতে বলেছে, আপনাকে সেই হাসপাতালে নিয়ে যাবো। অ্যাম্বুলেন্স রেডি আছে। তাকে আমি চিনি না। কথা শুনে মনে হলো লোকটি আমার উপকার করতে চায়। তার কথা মতো স্ত্রীকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে রওয়ানা দিই। কিছু দূর আসার পর অ্যাম্বুলেন্স চালক বলে, ডাক্তাররা মিরপুরে যে হাসপাতালে নিতে বলেছে সেখানে ভালো চিকিৎসা হয় না। তবে শ্যামলীতে আমার পরিচিত একটা হাসপাতাল আছে। নাম ঢাকা হেলথকেয়ার। সেখানে নিলে কম খরচে ভালো চিকিৎসা হবে। মাত্র হাজার দশেক টাকা খরচ হতে পারে। তার কথা শুনে আমিও রাজি হয়ে যাই।

আরও পড়ুন: ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে দালালসর্বস্ব ৭ হাসপাতালঃ জিম্মি রোগীরা (ভিডিও)

বেলাল হোসেন বলেন, পরে বুঝতে পেরেছি, যে লোক আমাকে ঢাকা হেলথকেয়ারে এনছে, সে ছিলো দালাল। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি। অথচ আমি এই হাসপাতালে এসেই জিম্মি হয়ে পড়েছি । মাত্র ১২ ঘন্টায় ওষুধপত্রসহ  আমাকে বিল ধরিয়ে দিয়েছে প্রায় ৪১ হাজার টাকা। হাজার দশেক টাকায় চিকিৎসা করানোর কথা বলে আমাকে এখানে যে এনেছে, তাকও খুঁজে পাচ্ছি না। বিলের উপরে দশ শতাংশ ছাড় দেওয়ার কথা থাকলেও তা না দিয়ে  রোগী জিম্মী করে রেখেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

শুধু বেলাল হোসেনই নন, আইসিইউ বেডে রোগীকে জিম্মি করে অর্থ আদায়ের এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে তানজুম আক্তার নামে অন্য এক রোগীর স্বজনের কাছেও। মা লাভলী বেগমকে নিয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর রাত ৮টার দিকে ঢাকা হেলথকেয়ারে আসেন তিনি এবং তাঁর ভাই-বোন। তাঁর মায়ের মানসিক সমস্যা থাকলেও দালালের খপ্পরে পড়ে লাভলী বেগমকে ভর্তি করানো হয় ওই হাসপাতালে। এরপর লাভলী বেগমকে চেতনানাশক ইনজকেশন দিয়ে রাখা হয় আইসিইউতে। মাত্র ১২ ঘণ্টায় আইসিইউ বাবদ বিল করা হয় ৪৫ হাজার টাকা। বিলের অংক দেখে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তানজুমের! বাধ্য হয়ে মুমূর্ষ মাকে হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে যেতে চান তিনি। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, টাকা পরিশোধ না করে রোগী বের করা যাবে না।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর তানজুম আক্তার বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, দালালের মাধ্যমে এখানে আমার মাকে এনেছি। কিন্তু তারা কি চিকিৎসা করাচ্ছে কিছুই বুঝতেছি না। মাত্র ১২ ঘন্টায় ওষুধ কিনে দিয়েছি ১৫ হাজার টাকার। এখানে আনার পর থেকেই মাকে আইসিইউতে ঢুকানো হয়েছে। তারা বলছে- মাকে আইসিইউতে না রাখলে মারা যাবে। কিন্তু মায়ের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, একদিন আগে তিনি যেমন ছিলেন এখন তার চেয়েও খারাপ অবস্থা। তাই  মাকে অন্যত্র নিতে চাইলেও  টাকার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিতেছে না। তাই বাবাকে গ্রামের বাড়ি নরসিংদী পাঠাইছি। টাকা ম্যানেজ করে আনার পর মাকে এখান থেকে নিয়ে যাবো।

গত ১০ আগস্ট নানান অনিয়মের প্রমাণ পেয়ে ঢাকা হেলথকেয়ার হাসপাতালটি বন্ধ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু বন্ধ করা হাসপাতালেই রোগী জিম্মি করে টাকা আদায় করছে কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে হাসপাতাল মালিকের সংগে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। মুহূর্তেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়, তাৎক্ষণিকভাবে আইসিইউ থেকে রোগীদের টাকা না নিয়েই বের করার অনুমতি দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে প্রতিবেদকের সামনে এমন ঘোষণা দিলেও বেলাল হোসেন-এর কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় ১৮ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, এই বিষয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশ না করতে  এই প্রতিবেদককে আর্থিক প্রস্তাবও দেন ঢাকা হেলথকেয়ার হাসপাতালের মালিক বাবুল চন্দ্র পাইক ওরফে পিকে বাবু।

রোগীদের জিম্মি করে ঢাকা হেলথকেয়ার হাসপাতালের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে মন্তব্য জানতে ১৬ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. মো. ফরিদ উদ্দিন মিঞার মুখোমুখি হয় বাংলাভিশন ডিজিটাল। তিনি জানান, যে অনিয়মের কারণে হাসপাতাল বন্ধ করা হয়েছে, সেগুলো তারা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। এজন্যই হাসপাতাল খোলার অনুমতি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

এতো তড়িঘড়ি করে হাসপাতাল খুলে দেওয়ার কারণ কী জানতে চাওয়া হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. মো. ফরিদ উদ্দিন মিঞার কাছে। ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনদের অভিযোগের ভিত্তিতে আবারও প্রশ্ন করা হয়, অনিয়মের প্রমাণ থাকার পরও হাসপাতাল খুলে দেওয়ার পেছনে আর্থিক সুবিধার প্রভাব রয়েছে কিনা? সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই, এমন কোনো অফারও পাননি তিনি। বলেন, 'আমি এমন একজন মানুষ, যাকে  টাকা দিয়েও কেনা যাবে না । তবে হাসপাতালের বিরুদ্ধে রোগীদের জিম্মি করে টাকা আদায়ের অভিযোগ পেলে আবারও তা বন্ধের আশ্বাস দেন তিনি।

বিভি/এমএস

মন্তব্য করুন: