সভাপতি-সম্পাদক দ্বন্দ্বে কুড়িগ্রাম বিএনপির এতিম দশা

কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সকল উপজেলা ও পৌর শাখাসহ অঙ্গদল সমূহে দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়েছে
গঠনতন্ত্র উপেক্ষা, স্বেচ্ছাচারিতা, গ্রুপিং, ব্যক্তিগত স্বার্থে কমিটি গঠন, সর্বোপরি কেন্দ্রীয় বিএনপি'র তদারকি না থাকায় কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপি এখন এতিম দশায় পরিণত হয়েছে। ফলে দুই গ্রুপের যাঁতাকলে পড়ে নেতাকর্মীরা ছটফট করছে।
জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর জেলা বিএনপি সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠিত হয়। তাতে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তাসভীর উল ইসলাম সভাপতি ও সাইফুর রহমান রানা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৫১ বিশিষ্ট কমিটি ২ বছরের জন্য গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের পর কিছুদিন যেতে না যেতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব দলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় দলের মধ্যে বিভক্তি। পরবর্তীতে তা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষেও রূপ নেয়।
গত ২০২০সালের ১৯ আগস্ট কুড়িগ্রাম শহরের ভেলাকোপা এলাকায় বিএনপির পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সামনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমানসহ ১০ জন মারাত্মক আহত হন। এ ঘটনায় কেন্দ্র থেকে সাইফুর রহমান গ্রুপের সাইফুর রহমানকে ও তাসভীর গ্রুপের যুগ্ম সম্পাদক সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদকে শোকজ করা হয়। সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা ও যুগ্ম সম্পাদক সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদকে এক মাসের জন্য দলের সকল কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন কেন্দ্রীয় বিএনপি। তাতেও গ্রুপিং মীমাংসিত হয়নি।
পরবর্তীতে গ্রুপিং আরো তীব্র আকার ধারণ করে দুটি পার্টি অফিসের জন্ম হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা শহরের পোস্ট অফিস পাড়া থেকে এবং সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম আমিন মোক্তার পাড়াস্থ অফিস থেকে দায়সারা ভাবে বিএনপি কার্যক্রম চালাচ্ছেন। দুই গ্রুপের গ্রুপিং ছড়িয়ে পড়েছে ওয়ার্ড পর্যায়েও। কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সকল উপজেলা ও পৌর শাখাসহ অঙ্গদল সমূহে দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়েছে। জেলা বিএনপির গ্রুপিং নিরসনের জন্য দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্থায়ী কমিটির সদস্য বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে গত ২০২১ সালের ১ফেব্রুয়ারী দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি ২০২১ সালের ১২ মার্চ দুই গ্রুপের ৭জন করে মোট ১৪ নেতার সাথে ঢাকায় বৈঠক করে কেন্দ্রে রিপোর্ট জমা দেন। ঐ বৈঠকের সদস্য জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি শফিকুল ইসলাম বেবু বলেন, ঐ রিপোর্ট এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
এদিকে, গত ১৬জুন'২০২৩ কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা সদর উপজেলা বিএনপির কমিটি অনুমোদিত হওয়া সত্ত্বেও একক সিদ্ধান্তে জহুরুল আলমকে আহবায়ক ও মাজেদুল ইসলাম তারাকে সদস্য সচিব করে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট আরও একটি আহবায়ক কমিটি গঠন করেন। পরে সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম সমর্থিত জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও দপ্তরের দায়িত্বে নিয়োজিত আশরাফুল হক রুবেল প্রেস রিলিজ দিয়ে ঘোষিত কমিটির অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। রিলিজে আরও বলা হয়েছে যে, সাধারণ সম্পাদক কর্তৃক ঘোষিত কমিটির কোন বৈধতা নেই। কেননা বর্তমানে কোন কমিটি প্রদান করলে তা কেন্দ্রের নির্দেশনা মোতাবেক করতে হবে। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক একক ভাবে কোন কমিটি দলের সংবিধান মোতাবেক অনুমোদনের এখতিয়ার রাখেন না। তিনি কেবল জেলা সভাপতি বরাবর সুপারিশ প্রদানের অধিকার রাখেন। সদর উপজেলা বিএনপির কমিটিসহ ইতোপূর্বে তিনি যে সকল কমিটি একক স্বাক্ষরে অনুমোদন করেছেন তা যেমন অবৈধ তেমনি অসাংগঠনিক। অতীতে ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী ও রাজিবপুর উপজেলা বিএনপির ক্ষেত্রে এমনটি করা হয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, গঠনতন্ত্র মোতাবেক দুই বছরের মেয়াদের কমিটি প্রায় ৮ বছর ধরে চলছে। দুই বছর পর পর কমিটি গঠিত হলে দলের মধ্যে এই বিভাজন থাকত না। তিনি আরো বলেন জেলা কমিটির ১৫১ সদস্যের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ২০ থেকে ২৫জন সক্রিয় থাকলেও গ্রুপিং এর কারণে কমিটির বড় অংশ নিষ্ক্রিয়। তৃণমূলের অভিমত দ্রুত কমিটি গঠন করলে গ্রুপিং নিরসন সম্ভব হবে।
এব্যপারে সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা বলেন, 'সভাপতি তাসভীর সাহেব কুড়িগ্রামের রাজনীতির মাঠে আন্দোলন সংগ্রামে উপস্থিত থাকেননা, আন্দোলন বেগবান করতেই সদর উপজেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি করে দিয়েছি। দীর্ঘ প্রায় কুড়ি বসরের পূরানো অফিসে না এসে সভাপতি তাসভীর কি কারণে শহরের অদুরে আলাদা অফিস খুলেছেন তা বোধগম্য নয় বলে মন্তব্য করেন সাধারণ সম্পাদক।'
এদিকে সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম বলেন, জেলা বিএনপির ৯০ভাগ নেতা কর্মী আমাদের সাথে রয়েছে। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কিছু লোক বিরোধীতা করতেই পারে। সম্মেলনের মাধ্যমে জেলা কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া কেন্দ্রকে অবহিত করা হয়েছে। সম্প্রতি সাধারণ সম্পাদক একক সিদ্ধান্তে সদর উপজেলা বিএনপির কমিটি দেয়া গঠনতন্ত্র পরিপন্থী বলে জানান তিনি। সাধারণ সম্পাদক এহেন কার্যক্রমের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দলের মহাসচিব বরাবর চিঠি লেখার কথাও জানান জেলা বিএনপির সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম ।
মন্তব্য করুন: