• NEWS PORTAL

  • বুধবার, ২৮ মে ২০২৫

Drama: Jamai Bou Chor
Drama: Jamai Bou Chor

সাংবাদিকতা সামলে সফল উদ্যোক্তা নীলফামারীর জুয়েল আহমেদ

নূর আলম সিদ্দিকী, নীলফামারী

প্রকাশিত: ১৭:১৮, ২৫ মে ২০২৫

ফন্ট সাইজ
সাংবাদিকতা সামলে সফল উদ্যোক্তা নীলফামারীর জুয়েল আহমেদ

বস্তায় চাষ করা আদা পরিচর্যা করছেন সাংবাদিক জুয়েল আহমেদ।

নীলফামারী জেলার এক ছোট্ট গ্রাম থেকে উঠে আসা জুয়েল আহমেদ। নিজের পরিশ্রম, মেধা ও উদ্যম দিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি স্বনির্ভর জীবনের পথ। এক সময়ের পেশাদার সাংবাদিক জুয়েল আজ একজন সফল উদ্যোক্তা। তিনি নিজ বাড়িতে গরু মোটাতাজাকরণ, মাছ চাষ, আদা চাষ ও দেশি মুরগি পালন করে শুধু নিজের জীবনই বদলে দেননি, বরং আশেপাশের অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন।

জুয়েল আহমেদ পেশাগত জীবন শুরু করেন বাবা প্রভাষক তোফাজ্জল হোসেনের নিজ হাতে গড়া স্থানীয় সাপ্তাহিক নীলসাগর পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে। ন্যায়ের পথে থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন তিনি। দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় কাটিয়েছেন সংবাদমাধ্যমে। তবে সাংবাদিকতা জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বরাবরই ছিল একধরনের চ্যালেঞ্জ। এই কারণেই একসময় নিজের জীবনে ভিন্ন কিছু করার ভাবনা আসে তার মনে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি ছোট আকারে খামার গড়ে তোলার চিন্তা করেন।

তিনি বলেন, "সংবাদপত্রে কাজ করতে গিয়ে কৃষি ও উদ্যোক্তাদের নিয়ে অনেক রিপোর্ট করেছি। তখনই ভাবনায় আসে, কিছু করার। সেটাই আমার অনুপ্রেরণা।

নিজের খামারের গরু পরিচর্যা করছেন জুয়েল আহমেদ।

জন্মস্থান নীলফামারীর রামনগর ইউনিয়নের চাদের হাটের দেওয়ানী পাড়ায় নিজের বসতবাড়ির খালি জায়গা থেকেই শুরু হয় জুয়েলের নতুন পথচলা। বাড়ির উঠোন, ফাঁকা জায়গায় প্রথমে শুরু করেন দেশি গরুর মোটাতাজাকরণ প্রকল্প। নাম দেয়া হয় ‘নীবিড় এ্যাগ্রো ও ডেইরি ফার্ম’। করেছেন সরকারি নিবন্ধনও। দুইটি গরু দিয়ে শুরু করে এখন তার খামারে গরুর সংখ্যা ১৫ এর বেশি। 

বিশেষভাবে দেশীয় পদ্ধতিতে গরু লালন-পালন করেন তিনি, যাতে কম খরচে ভালো মুনাফা পাওয়া যায়। এ কাজে নীলফামারী জেলা ও উপজেলা প্রাণী সম্পদ দপ্তরের কর্মকর্তা এবং চিকিৎসকদের আন্তরিকতার অভাব ছিলোনা। গরুর খামারের পেছনেই তৈরি করেন 

একটি বড় পুকুর, যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করছেন তিনি। তেলাপিয়া, রুই, কাতলা, সিলভার কার্পসহ নানা জাতের মাছ রয়েছে তার পুকুরে। স্থানীয় বাজারে এই মাছের চাহিদা ব্যাপক। সপ্তাহে একাধিকবার স্থানীয় বাজারে মাছ সরবরাহ করেন তিনি।

এছাড়াও পলিব্যাগে বা বস্তায় আদা চাষ করে চমক দেখিয়েছেন জুয়েল। সামান্য জায়গায় কিভাবে আদা চাষ করে লাভবান হওয়া যায়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ তিনি। তার বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ১ হাজার বস্তায় বেড়ে উঠছে আদার গাছ, যেগুলো থেকে ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে। আদা চাষে ‘মসলার উন্নত জাত, প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, প্রকল্প সম্প্রসারন অধিদপ্তর হটিকালচার সেন্টার বুড়িরহাট রংপুর’ একাজে বেশ আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছে।

জুয়েল আহমেদের চাষ করা আদা।

জুয়েলের উদ্যোগের আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে দেশি মুরগি পালন। বাড়ির উঠানে ঘেরা পরিবেশে দেশি জাতের মুরগি লালন-পালন করে বাজারজাত করছেন তিনি। মুরগির মাংস ও ডিম স্থানীয়ভাবে ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অগ্রিম বুকিং দিয়ে রাখেন। নির্ভেজাল দেশি মুরগির মাংশ ও ডিমের স্বাধ গ্রহন করছেন পরিবারের সবাই। 

তিনি বলেন, “দেশি মুরগি পালন করতে গেলে একটু সময় ও যত্ন লাগে, তবে বাজারে এর দাম অনেক বেশি। তাই আমি এটা নিয়মিত করছি। স্থানীয় নারীরাও এখন আমার কাছ থেকে শিখে নিজেদের বাড়িতে ছোট খামার গড়ে তুলছেন।”

জুয়েল আহমেদ আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করতেও দক্ষ। ইউটিউব, কৃষিভিত্তিক ফেসবুক গ্রুপ ও সরকারি কৃষি অফিসের পরামর্শ নিয়ে নিজের খামারে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেন তিনি। যেমন, গরুর খাবার হিসেব করে দেওয়া, মাছের পিএইচ মাপা, কিংবা মুরগির বাচ্চা ফোটানোর ইনকিউবেটর ব্যবহার—সব কিছুতেই তিনি আধুনিকতা এনেছেন।

জুয়েল আহমেদ জানান, চ্যালেঞ্জিং পেশা সাংবাদিকতা। তারওপর রংপুর বিভাগীয় শহরে সাংবাদিকতা সামলে যে টুকু সময় পান তখনি ছুটে আসেন নীলফামারীর গ্রামের বাড়িতে। পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে ৬৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ছুটে আসেন খামারে। নীলফামারী আর রংপুরে স্থায়ী বসবাসের কারনে গ্রামের বাড়িটি ভূতুরে হয়ে ছিলো। পালাপর্বন ছাড়া বাড়িতে খুব একটা আশা হতোনা। যদিও বৃদ্ধ মা মনোয়ারা বেগম (৭৬) এর মন টিকতো না শহরে। বার বার স্বামীর ভিটেতে মন পড়ে থাকতো আর শরীর থাকতো ইটপাথরের শহুরে। খামার তৈরির পর থেকে মায়ের মন বসেছে বাড়িতে। সবুজ প্রকৃতি আর প্রাণীদের কলকাকলিতে বাড়িতে এখন এক অন্যরকম আবহও।   

উদ্যোক্তা হওয়ার পথে তার সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলেন তার পরিবার। স্ত্রী ও সন্তানরা শুরু থেকেই তার উদ্যোগে পাশে ছিলেন। এছাড়া স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, কৃষি অফিস, প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকেও পেয়েছেন সহযোগিতা। তার এই পরিকল্পনা স্থানীয় বেকার যুবকদেরও উদ্যোক্তা হতে অনুপ্রাণিত করছেন তিনি।

দেশি মুরগির খামারও রয়েছে সফল এই উদ্যোক্তার।

প্রতিটি সফলতার পেছনে লুকিয়ে থাকে সংগ্রামের গল্প। জুয়েল আহমেদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। খামার শুরু করার পর প্রথম দিকে লোকসানের মুখে পড়তে হয় তাকে। খাদ্য খরচ, রোগ প্রতিরোধ, বাজারের ওঠানামা সবকিছু মিলিয়ে কষ্টে চলেছে অনেক সময়। 

তবে তিনি বলেন, "আমি জানতাম আমার লক্ষ্য কোথায়। তাই যত কষ্টই হোক, হাল ছাড়িনি। আজ সেই পরিশ্রমের ফল পাচ্ছি। জুয়েল আহমেদের খামার আজ শুধু একটি পরিবারের আয়ের উৎস নয়, বরং স্থানীয় অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তার খামারে কাজ করছেন স্থানীয় ৫-৭ জন যুবক। তিনি অনেককেই প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন। ফলে স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি, একটি সমৃদ্ধ উদ্যোক্তা পরিবেশ তৈরি হয়েছে তার চারপাশে।

জুয়েল আহমেদ থেমে থাকতে চান না। তার লক্ষ্য তার খামারকে আরও সম্প্রসারণ করা। গরুর খামারের জন্য আরো আলাদা একটি শেড নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। মাছ চাষে বায়োফ্লক পদ্ধতি চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। আদা চাষকে বাণিজ্যিক পরিসরে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন তিনি। এছাড়া দেশি হাঁস পালন এবং ছাগল পালনের দিকেও নজর দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, “আমার স্বপ্ন হলো, আমার মত আরও ১০ জন যুবক যেন উদ্যোক্তা হতে পারে। আমি চাচ্ছি আমার অভিজ্ঞতা তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে।” জুয়েল আহমেদের এই পথচলা অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে। নীলফামারীসহ আশেপাশের এলাকায় অনেকে তাকে অনুসরণ করে নিজেদের উদ্যোগ শুরু করছেন। 

জুয়েল আহমেদ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন, ইচ্ছা শক্তি, পরিশ্রম আর পরিকল্পনা থাকলে নিজের অবস্থান নিজেই তৈরি করা যায়। সাংবাদিকতা পেশা থেকে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা তার এই গল্প শুধুমাত্র একটি জীবনের পরিবর্তন নয়, বরং একটি এলাকার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি।

একজন মানুষ যখন নিজের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং আত্মবিশ্বাস দিয়ে পরিবর্তনের পথে হাঁটে, তখন তার গল্প হয়ে ওঠে শত শত মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস। জুয়েল আহমেদ ঠিক সেই উদাহরণ—যিনি কেবল নিজে বদলাননি, বদলে দিয়েছেন চারপাশের অনেক কিছুই।

বিভি/এজেড

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2