ধর্ষণ- মামলাতেই সামলে উঠে ধর্ষক!

নাসরীন গীতি ●
হাইকোর্টে পুলিশের পক্ষ থেকে দাখিলকৃত প্রতিবেদনে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণের মামলা করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ২০১৯ সালে। মামলা হলে তো এতোগুলোর বিচারও নিশ্চয়ই হয়েছে। এর মধ্যে অনেক আসামি সাজাও পেয়েছে। কিন্তু ধর্ষণ কি বন্ধ হয়েছে?
প্রশ্ন হলো- বছরের পর বছর মামলা হচ্ছে, বিচার হচ্ছে; তাহলে ধর্ষণের মতো বর্বর, নৃশংস ঘটনা ঘটছে কেন? খুব নিকট অতীতে তাকালেই দেখা যায়, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ, হাতিয়ায় ধর্ষণের নিকৃষ্টতম ঘটনা।
গত পাঁচ বছরেরও একটু আগে যাই। এর আগের ১৫ বছরে ধর্ষণের চিত্রটা কেমন ছিলো দেখা যাক। নথিপত্র অনুযায়ি, ২০০১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পুলিশের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে পাঁচ হাজার তিনটি ধর্ষণের মামলা হয়। এর মধ্যে রায় ঘোষণার হার ৩ দশমিক ৬৬ ভাগ এবং সাজার হার শূন্য দশমিক ৪৫ ভাগ।
চলে যাওয়া বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আইন শালিশ কেন্দ্র একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছিলো। তাদের হিসেব মতে, চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৪৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ এর মধ্যে চলতি মাসের প্রথম ২৫ দিনে ৫৯টি৷ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪১ জন নারীকে৷ ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন৷ আর ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১৯২ জন৷
২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৭৩২ জন৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে ৷ ২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৪১৩ জন৷ হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। এগুলোর মধ্যে বেশ ক'টি ঘটনার মামলাও হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়েছে অনেকগুলোর।
কেন এমন হয়? কেন মামলাতে গিয়েই বিচার থেমে যায়?
মূলত: মামলা দায়ের থেকে শুরু করে তিনটি ধাপে ধর্ষণের মামলা দূর্বল করে দেওয়া হয় বলেই ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না বিচারপ্রার্থীরা। আইনজীবী, ফরেনসিক বিভাগের কর্মকর্তা ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, থানা, শারীরিক পরীক্ষা ও সাক্ষী উধাও- এই তিন ধাপের গড়-মিলের মধ্যদিয়ে ধর্ষণ মামলা দূর্বল করা হয়। সামাজিকভাবে প্রভাবশালীদের ভয়-ভীতি প্রদর্শনের কারণে সাক্ষীদের পিছিয়ে পড়ার প্রবণতাও রয়েছে। মূলতঃ এসব কারণে ধর্ষণের মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলেই বাংলাদেশে হাজারে মাত্র চারজন আসামি ধর্ষণ মামলায় সাজা পায়৷
ধর্ষণ একটি অপরাধ। সমাজবিজ্ঞান, অপরাধবিজ্ঞান কিংবা মনোবিজ্ঞান অথবা ধর্মীয় নৈতিকতায়ও যদি আমরা বলি, ধর্ষণ একটি অপরাধ। কিন্তু এই অপরাধের সাজা কেন হয়না বা ভিকটিম কেন সহজে বিচার পায় না।
বাংলাদেশে অনেক কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও অনেক নারী প্রায়ই আইনের অধীনে অর্থবহ আইনী প্রতিকার পান না এবং নির্যাতনকারীদের খুব কমই বিচারের আওতায় আনা যায়। অনেক ক্ষেত্রে বিচার প্রায় বিলম্বিত হয় বা বছরের পর বছর ধরে টানা হয়। কোনো সাক্ষী সুরক্ষা আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ না করা, নির্যাতনকারীদের ভয় বা হুমকি, আদালতে মামলা চালিয়ে যাওয়ার আর্থিক ও মানসিক চাপের কারণে অনেক নারী প্রায়ই আদালতের বাইরে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করে ফেলেন। ফলে সাজা না পেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ষকের আস্ফালন বেড়ে যায়। আর সমাজে যারা অপরাধী মন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাদের অপরাধ চিন্তা আরো বেড়ে যায়। কারণ তারা দেখে অপরাধ করে পার পাওয়া যায়। আইন-আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারাই সদর্পে হাঁটে। লুকোতে হয় নির্যতনের শিকার ঐ নারীকেই, তার পরিবারকেই।
এসব থেকে উত্তরণের পথ সুগম হবে কবে? আইন কবে চলবে আইনের গতিতে??
বিভি/নিউজ এডিটর