কাহিনীপ্রধান উপন্যাস ‘কসমোপলিটান হোমিও’র সমকাল ও অন্যান্য

গ্রামকেন্দ্রিক কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থায় গ্রামের কৃষকসমাজ এবং সামন্তদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিককালে ইংরেজি উপন্যাসের রীতিতে নায়ককে প্রধান করে বাংলা উপন্যাস রচিত হয়। গ্রামকেন্দ্রিক উপন্যাসে চরিত্রকে কেন্দ্র করে কাহিনী অগ্রসর হয়। এখানে অর্থনীতির চালিকাশক্তি সামন্ত প্রভুদের হাতে থাকে বলে ব্যক্তিই উপন্যাসে প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠে। মূলত চরিত্রকে প্রধান করে কাহিনী আবর্তিত হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিককালের উপন্যাসের রীতি অবলম্বন করে সামন্তযুগের ভাবধারায় রচিত চরিত্রপ্রধান উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘কবি’, ‘পথের পাঁচালী’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ ইত্যাদি।
কৃষিনির্ভর অর্থনীতি বিলুপ্তের সাথে সাথে নগরের বিকাশ ঘটে। কল—কারখানা এবং ব্যবসা—বাণিজ্য নগরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। গ্রামের অর্থনীতি ভেঙে পড়ায় কর্মের আশায় মানুষ দলে দলে গ্রাম থেকে নগরে এসে কৃষক থেকে শ্রমিকে রূপান্তর এবং নগরই সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী হলে নগরজীবন ভিত্তিক উপন্যাসের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ সময়ে চরিত্রকে প্রধান করে নগরকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনা করতে দেখা যায়। নগরজীবন নিয়ে উপন্যাস রচয়িতারা হলেন আবুল ফজল, আবু রুশদ, রশীদ করীম, আবদুল গাফফার চৌধুরী, দিলারা হাশেম, হুমায়ুন কাদির, সৈয়দ শামসুল হক, রাজিয়া খান, শওকত আলী, রিজিয়া রহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ূন আহমেদ, নাসরিন জাহান, শহীদুল জহির প্রমুখ। এঁরা নগরকেন্দ্রিক উপন্যাসে চরিত্রকে প্রধান করে উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে সামন্তকালের আদর্শকে ত্যাগ করতে পারেননি।
ঔপন্যাসিক রহমান রনি চট্টগ্রামের পুরান গির্জা, হাজারী গলি, আমানত শাহ মাজার এবং লালদিঘিপাড় এলাকাগুলোতে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং ভাসমান মানুষের জীবন নিয়ে নগরকেন্দ্রিক ‘কসমোপলিটান হোমিও’ উপন্যাসটি রচনা করেন। ‘কসমোপলিটান হোমিও’ উপন্যাসটি মূলত কাহিনী বা ঘটনা কেন্দ্রিক। ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে আলফ্রেড, সিলভিয়া, জয়িতা, স্টিল, কাল্লু, আকাশ, আনন্দ, শান্তনু ও নুরুসহ বিভিন্ন ধরনের চরিত্রের সমাবেশ ঘটে। এ উপন্যাসটি মূলত কাহিনীপ্রধান, চরিত্রপ্রধান নয়। জহির রায়হান সম্ভবত এ অঞ্চলের প্রথম কাহিনীপ্রধান ঔপন্যাসিক। এ ধারার নগরকেন্দ্রিক উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’ ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কাহিনীপ্রধান উপন্যাস ‘পূর্ব পশ্চিম’ (প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব) রচনা করেন। এছাড়াও মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ মূলত কাহিনীপ্রধান। অপর দিকে ‘কর্নেলকে কেউ লেখে না’ উপন্যাসটি চরিত্রপ্রধান। এটি বলার অর্থ হচ্ছে একজন ঔপন্যাসিক দুই আঙ্গিকে উপন্যাস রচনা করতে পারেন।
সাধারণত কাহিনীপ্রধান উপন্যাসে প্রতিটি চরিত্র কাহিনীর প্রয়োজনে আগমন ঘটে। এক্ষেত্রে কাহিনীই মুখ্য হিশেবে বিবেচিত। কাহিনীপ্রধান ধারাটি নাট্যকার ব্রের্টল ব্রেশট তার নাটকে সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছেন। এতে নাটকের কাহিনীর সঙ্গে দর্শকের সরাসরি সংযোগ ঘটে। ব্রেশটের কাহিনীনির্ভর সূত্রটি পরবতীর্কালে বিভিন্ন দেশের ঔপন্যাসিকরা ব্যবহার করে আসছেন।
‘কসমোপলিটান হোমিও’ উপন্যাসে আলফ্রেড চরিত্রটি সামন্তকালের চরিত্রের মতো প্রধান করে চিত্রিত করেননি ঔপন্যাসিক। আলফ্রেড চরিত্রটি অন্যান্য চরিত্রের সঙ্গে সমান্তরালভাবে কাহিনীর প্রয়োজনে অগ্রসর হয়েছে। আলফ্রেড বিপ্লব করবে,এ কারণে সে পত্রিকার হকার নুরুকে দিয়ে প্রচারপত্র বিলি করে। কোন্ প্রক্রিয়ায় আলফ্রেড বিপ্লব করবে তার কোনো ঘোষণা নেই। আলফ্রেড বারবার বলছে 'সবাই’কে নিয়ে বিপ্লব করবে। এখানে ‘সবাই’ শব্দটি ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আমরা ধরে নিতে পারি ‘সবাই’ বলতে আলফ্রেড বোঝাতে চেয়েছে সমাজতান্ত্রিক অথবা গণতান্ত্রিক পন্থায় বিপ্লব করবে। এটি ইঙ্গিতধর্মী উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র। এখানে আলফ্রেডের কোনো ইশতেহার নেই। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিশেবে উল্লেখ করা যায় ক্ষুদিরাম, তিতুমির, রজব আলী, নুরুলদীন ও সিপাহি বিদ্রোহের বিপ্লবীদের ইশতেহার নামে সেরকম কিছুই ছিলো না বলেই এদের বিপ্লব সফল হয়নি। আলফ্রেডের বিপ্লবও সফল হয়নি। অন্যদিকে সূর্য সেন ও সুভাষ বসুর ইশতেহার থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে তাদের বিপ্লবও সফল হয়নি।
সভার দিন আলফ্রেডকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। এখানে তার পরিণতি কীভাবে হয়েছে ঔপন্যাসিক বলেননি। আলফ্রেডের স্বপ্ন এবং আচরণ সিলভিয়ার ভালোলাগে। আলফ্রেড তার অনিশ্চিত জীবন সম্পর্কে জানে বলেই সিলভিয়াকে ভালোবাসায় জড়ায়নি। বারবার সিলভিয়াকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এক্ষেত্রে আলফ্রেড সততার পরিচয় দিয়েছে।
সিলভিয়ার বান্ধবী জয়িতা। সিলভিয়া ও জয়িতা দুজনেই স্মার্ট তরুণী এবং মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। তারাও আলফ্রেডের মতো আন্দোলন করে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে। আলফ্রেডকে খুঁজে না পাওয়ার কারণে তাদের স্বপ্নও সফল হয়নি।
স্টিল পতিতা, কাল্লু মাস্তান। স্টিল কাল্লুকে ভালোবাসে। স্টিল কাল্লুর কাছে আসলে কাল্লু তাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে। এতে স্টিল কিছুই মনে করে না। স্টিল পতিতাবৃত্তি ছেড়ে কাল্লুকে বিয়ে করে সংসার পাততে চায়। তা আর হলো কই। এদেরকে এখনও উল্লেখিত এলাকায় হরহামেশা দেখা যায়।
এসব চরিত্র ‘কসমোপলিটান হোমিও’ উপন্যাসে কাহিনীর প্রয়োজনে দেখা গেছে। কোনো চরিত্রকে মহিমান্বিত করেননি ঔপন্যাসিক। সে জন্য প্রশ্ন উঠতে পারে ‘কসমোপলিটান হোমিও’ উপন্যাসে কোনো চরিত্র দাঁড়ায়নি।
কাহিনীনির্ভর উপন্যাস চরিত্রপ্রধান নয়, কাহিনীপ্রধান, ভাষাও কমিউনিকেটিভ। এতে পাঠক খুব সহজে ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। ছোট ও মাঝারি দৈর্ঘ্যের বাক্যে রচিত এ উপন্যাস। পাঠক এ ধরনের বাক্য সহজে মনে রাখতে পারে।
‘কসমোপলিটান হোমিও’ উপন্যাসে আবেগ—আপ্লুত হয়ে বাহুল্যপূর্ণ পরিবেশের বর্ণনা বর্জন করেছেন রহমান রনি। বাহুল্যপূর্ণ পরিবেশের বর্ণনা পড়তে পড়তে পাঠক ক্লান্তি বোধ করে।
‘কসমোপলিটান হোমিও’ উপন্যাসে পরিবেশ নয়, পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে চরিত্রগুলো বিকশিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের উপন্যাস ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ পরিবেশ বর্ণনার বাহুল্যতা নেই। পরিশীলিতভাবে পরিস্থিতির বর্ণনা করেছেন ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। এ উপন্যাসে পরিবেশের চেয়ে সংকটময় পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে সান্তিয়াগো তার কার্যক্রম নিয়ে অগ্রসর হয়।
ওপরের কথামালা থেকে বলা যায়, রহমান রনির নগরকেন্দ্রিক ‘কসমোপলিটান হোমিও’ অস্থির সময়কে সামনে রেখে রচিত। এ উপন্যাসে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে নগর জীবনের চরিত্রগুলোকে অনিবার্য এবং প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন ঔপন্যাসিক।
বাংলা উপন্যাসে আবেগ আপ্লুত হয়ে পরিবেশ বা প্রকৃতির অনর্থক বর্ণনা দেখা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে এ ধরনের অহেতুক এবং বিরক্তিকর বর্ণনার উপন্যাস প্রকাশ হয়ে আসছে। এসব প্রাচীনপন্থি ঔপন্যাসিকরা বর্ণনাধর্মী উপন্যাসের রীতি ত্যাগ করতে পারেননি। যেখানে কম শব্দ ব্যবহার করে ইঙ্গিতের মাধ্যমে পরিবেশ বর্ণনার রীতি প্রচলিত রয়েছে, সেখানে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রাখলে বর্ণনাবহুল পরিবেশ আর প্রাসঙ্গিক নয়। কম শব্দ ব্যবহার করে ইঙ্গিতের মাধ্যমে পরিবেশ বর্ণনার উপন্যাস হচ্ছে ‘আউট সাইডার’ এবং ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ অন্যতম। রহমান রনি ‘কসমোপলিটান হোমিও’তে কম শব্দ ব্যবহার করে ইঙ্গিতের মাধ্যমে পরিবেশ বর্ণনায় সফল হয়েছেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুর পরিবর্তন ঘটে। উপন্যাসের রীতির পরিবর্তনও অনিবার্য। বর্তমানের অনেক উপন্যাসে স্তবক থেকে স্তবকে সীমিত শব্দ ব্যবহার করে বাস্তবের বর্ণনাসহ প্রতিবেদন বা তথ্যের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন ‘মাই নেইম ইজ রেড’ উপন্যাসটি এখানে উল্লেখ করা যায়।
এ অঞ্চলের ঔপন্যাসিকদের মনে রাখতে হবে যে, বিদেশিদের ব্যবস্থাপত্রে উপন্যাস রচনার দিন শেষ। দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিষয়াদি বিবেচনা, আফ্রিকা এবং ল্যাতিন আমেরিকার মতো নিজস্ব প্রকরণ—প্রকৌশল উদ্ভাবন করে উপন্যাস রচনা এখন সময়ের দাবি।
উল্লেখিত বিষয়াদি বিবেচনায় রেখে নগরকেন্দ্রিক ‘কসমোপলিটান হোমিও’ উপন্যাসে পিনদ্ধ বুননে উপস্থাপন, ইঙ্গিতে পরিবেশ—পরিস্থিতি বর্ণন, স্বল্প দৈর্ঘ্য সংলাপ ও কম শব্দে বাক্য ব্যবহার এবং অতি নাটকীয়তা পরিহার এ উপন্যাসের অন্যতম প্রাণশক্তি।
কসমোপলিটান হোমিও উপন্যাসের প্রচ্ছদ করেছেন মঈন ফারুক। এবারের অমর একুশে বইমেলায় চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনীর এ বইটির মূল্য : ৫০০ টাকা।
মন্তব্য করুন: