ভূমি খেকো ভূমি অফিস (প্রথম পর্ব)
২০০ কোটি টাকার অর্পিত সম্পত্তি গ্রাস করার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন!

চট্টগ্রামে ভূমি অফিস রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা পালন করায় সরকারি শত শত কোটি টাকার সম্পত্তি গ্রাস করছে ভূমিদস্য সিন্ডিকেট। প্রথমে লিজগ্রহণ, অতঃপর সম্পত্তির শ্রেনী পরিবর্তন, জাল খতিয়ান, বানোয়াট দলিল, যোগসাজসী আম মোক্তারনামা, ভুয়া ওয়ারিশ সনদ ও এনআইডি তৈরীর মাধ্যমে সরকারি বিপুল সম্পত্তি আত্মসাতের বিষয় ওঠে এসেছে সরকারি তদন্তে।
কিন্তু প্রশাসন দায়সারা তদন্ত করলেও অপকর্মে জড়িত ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় ফাঁকতালে সরকারি সম্পত্তি হাতিয়ে নিচ্ছে ভূমিদস্যুরা।
চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র এম এম আলী রোডে অবাঙালি সৈয়দ আহমদ হাশেমীর ৮৭শতক সম্পত্তি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে হাশেমী বাংলাদেশ ত্যাগ করে পাকিস্তান গিয়ে মারা যান। কিছুদিন তার চাচাতভাই আমীন আলী এই সম্পত্তি ভোগ করেন। ১৯৮৭ সালে জেলা প্রশাসক পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেন। ১৯৮৮ সালে মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামসহ ৯জনের অনুকূলে একসনা ইজারা দেয় প্রশাসন।
এক পর্যায়ে জেলা প্রশাসনের কর্মচারী মোহাম্মদ ইউনুস গং এর সহযোগিতায় অজ্ঞাতনামা রাইছা আজিজের নামে বিএস খতিয়ান তৈরী করে ভূমিদস্যুরা। অমর কুমার শর্মা গ্রহীতা সেজে ঠিকানাবিহীন রইসা আজিজকে দাতা সাজিয়ে ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর ১৫৫১৪নম্বর দলিল সৃজন করে। এই দলিলের ভিত্তিতে বৈধলীজি মনোয়ার হোসেন গংয়ের বিরুদ্ধে মিস মামলা করেন। পরবর্তীতে একই বছরের ২৩ অক্টোবর আবার ১৫৯৯৬ নম্বর বায়নানামা দলিল তৈরী করেন।
মূল সম্পত্তির মালিক সৈয়দ আহমদ হাশেমী পাকিস্তান চলে যাওয়ার পরও জনৈক নুরুল আলম আমমোক্তার সেজে ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর ভূমি সচিব বরাবর আবেদন করেন।অপর একজন আলী নু্র চৌধুরী উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করেন। ভূমিদসূ চক্রের অপর সদস্য নাজিম উদ্দিন ২০১৫ সালের ১৯ মার্চ ৪০৩৮ বায়নানামা দলিল তৈরী করেন।এভাবে ভূমিদসূ চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন আদালতে একাধিক মিথ্যা মামলা করেন এবং নকল ব্যাক্তি সেজে ও সাজাইয়া প্রায় ২০০কোটি টাকার এই সম্পত্তি আত্মসাতের প্রচেষ্টা চালান।
এই সম্পত্তির বিএস জরিপ সরকারের নামে না হয়ে রইসা আজিজের নামে হওয়ায় তা সংশোধেনের জন্য ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব আবদুল মালেক প্রতিবেদন পেশ করেন।একই প্রতিবেদনে বলা হয়-বিএস জরিপ সরকারের নামে না হওয়ার সুযোগে ভূমিদস্যু জালিয়াত চক্র বিভিন্ন ধরণের জাল, ফেরবী, বানোয়াট দলিল, যোগসাজসী আম মোক্তারনামা, বায়ানানামা দলিল, ভুয়া ওয়ারিশ সনদ ও এনআইডি তৈরী করে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের প্রচেষ্টায় লিপ্ত। অবাঙালী হাশমীর কোন ওয়ারিশ এদেশে বসবাস করে না। রীট পিটিশনকারী নারগিস আক্তার সরকারি পরিত্যাক্ত সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য ভিত্তিহীন আবেদন দাখিল করেন।
অর্ধশত বছর পর লীজ গ্রহণকারী, ভূমিদস্যু জালিয়াত চক্র ও জেলা প্রশাসন এক হয়ে এই ২০০কোটি টাকার সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য ৩জুলাই সার্কিট হাউজে বৈঠক করেন। জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেছে রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা পালনের। অথচ মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রে একসাথে ৮৭ শতক সম্পত্তি ব্যাক্তি পর্যায়ে নেই বললেই চলে।তাই দুইশ’কোটি মূল্যের এই সোনার হরিণের দিকে সবসময় লোলুপ দৃষ্টি ছিল ভূমিদস্যুদের।
এই বিষয়ে সনাক ও টিআইবি চট্টগ্রাম মাহনগর সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, প্রশাসনের সহযোগিতায় চট্টগ্রামে সরকারি সম্পত্তি দখল-বেদখলের বিশাল লড়াই চলছে।এই দপ্তরের মন্ত্রী থাকলে কোন কোন জায়গাতে শত শত বাড়িও করা যায়। প্রশাসন বেপেরোয়া হলে সবকিছু দৃশ্যমান হয়ে যায়।তিনি প্রশ্ন রাখেন প্রশাসন জড়িত না থাকলে এসব বন্ধ করে না কেন?
ভূমি আইন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. নওয়াব আসলাম হাবিব বলেন, পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকা সত্বেও ভূমি অফিসে এসি ল্যান্ড পদায়ন করায় তাদের অদক্ষতার সুযোগ নিচ্ছে নিম্ন পদস্থ কর্মচারীরা। তাই সুযোগসন্ধানী মহল ভূমি অফিসের যোগসাজশে নানভাবে সরকারী সম্পত্তি আত্মসাতের সাথে জড়িত। এব্যাপারে সরকারের ব্যবস্থা গ্রহন করার পাশাপাশি এসব সম্পত্তিতে সরকারি অফিস গড়ে তোলা উচিত মনে করেন তিনি।
এদিকে বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন বলেছেন, তাদের মূল কাজ ভূমি ব্যবস্থাপনা। তিনি ভূমিদস্যুর পাশাপাশি অসৎ কর্মচারী থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, এসব অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেবেন জানালেন তিনি।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: